Pervez Musharraf Death

শেষ দিল্লি সফরে ‘মুন্না’র সঙ্গে দেখা হয়নি ধাই-মায়ের

২০০১ সালে আগরা সম্মেলনের সময়ে দিল্লির জন্মভিটেয় এসেছিলেন পারভেজ়। এই কুলফিওয়ালা গলির পোশাকি নাম এখন প্রতাপগড় রোড। আগে নাম ছিল কুচা সাদুল্লা খান রোড।

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:৪১
Share:

পাকিস্তানের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সামরিক প্রধান তথা প্রেসিডেন্ট পারভেজ় মুশারফ। ফাইল ছবি।

সময়টা ইউপিএ সরকারের প্রথম ইনিংসের প্রথম বর্ষপূর্তির মুখ। দিল্লির বসন্ত শেষে তখন হাল্কা বারুদের আঁচ। আসছেন পাকিস্তানের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সামরিক প্রধান তথা প্রেসিডেন্ট পারভেজ় মুশারফ। সীমান্তকে শিথিল করতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের প্রস্তাবে হঠাৎই সাড়া দিয়েছেন তিনি। বিনিময়ে কড়ায় গণ্ডায় আদায় করতে চান কাশ্মীর নিয়ে তাঁর শর্ত মোতাবেক প্রতিশ্রুতি।

Advertisement

তবে শুধু হাইভোল্টেজ কূটনীতিই নয়, সফরে কিছুটা সখ্যের হাওয়া খেলিয়ে দিতেই ক্রিকেট কূটনীতির আবরণ তৈরি। স্থির রয়েছে, ২০০৫-এর সেই মাঝ এপ্রিলে দিল্লির স্টেডিয়ামে ভারত-পাকিস্তান এক দিনের ম্যাচও দেখবেন তিনি, শীর্ষ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আগে।

সাজ সাজ রব রাজধানীতে। যতটা না ক্রিকেট সাংবাদিকদের, তার চেয়ে বেশি আমাদের। অর্থাৎ যারা প্রতিদিন সন্ধ্যায় শাস্ত্রীভবন থেকে অফিস ফিরে ভারত-পাক বাগ্‌যুদ্ধের রিপোর্ট লিখি। এ বার সাক্ষাৎ পাক জেনারেল হাজির শহরে! তাঁকে ধরতে হবে সমস্ত দিক থেকে। মাঠে কত ক্ষণ থাকবেন, তাঁর হোটেলকে কী ভাবে দুর্গে পরিণত করা হবে, নৈশভোজের মেনুতে কী কী থাকছে! এর আগে মুশারফ এসেছিলেন ২০০১-এর জুলাই মাসে আগরা শীর্ষ বৈঠক করতে। কিন্তু সে বার বৈঠক ভেস্তে যাওয়ায় তাঁর অজমের যাওয়ার সাধ পূর্ণ হয়নি। এ বার কোনও ঝুঁকি না নিয়েই দিল্লি আসার আগেই হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির মাজারে ‘কদমবুসি’ সেরে দিল্লি এসেছেন। নেমেই বলেছেন, এ আগমন নাকি ‘আমন’-এর (শান্তি) পয়গাম (বার্তা) নিয়ে। কাশ্মীরকে বরাবর পাখির চোখ দেখা মুশারফ এর পরে কোন দাবার চাল দেবেন তা নিয়ে তখন কিছুটা ত্রস্ত সাউথ ব্লক। তা ছাড়াও একটি বড় গলদও সামলাতে হিমশিম তখন মনমোহন সরকার। ভারতের পতাকা উল্টো করে লাগিয়ে ইসলামাবাদ থেকে জয়পুরে নেমেছিল পাক প্রেসিডেন্টের বিশেষ বিমান! সফরই না ভেস্তে যায়! তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিজেপি শোরগোল ফেলে দাবি তোলে, ক্ষমা চাইতে হবে খোদ মুশারফকেই। শেষ পর্যন্ত এই ‘অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির’ জন্য আম্তরিক দুঃখপ্রকাশ করে পাকিস্তান।

Advertisement

এ হেন স্নায়ু টানটান ‘ম্যাচ’ শুরু হওয়ার আগেই আমার কাছে খবর এল, দিল্লির দরিয়াগঞ্জের সরু, মাছি-কন্টকিত কুলফিওয়ালা গলিতে মুশারফের জন্য নাকি অপেক্ষা করছেন পারভেজ়ের ধাই মা! যাঁর নাম আনারো বিবি। ৮ মাস বয়স থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন তিনি তাঁর আদরের মুন্নাকে (মুশারফ)। ওই গলির নেহারওয়ালি হাভেলিতে বসে তিনি অপেক্ষা করছেন পাক প্রেসিডেন্টের জন্য। সফরসূচিতে এ বার আদৌ নেই। কিন্তু আনারোর আশা, মুন্না এ বারেও আসবেন। আগরা বৈঠকের সময়ে এসে মুশারফ গিয়েছিলেন গলিতে।

এমন খবর কানে এলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়নো ছাড়া অন্য বিকল্প থাকে না। পৌঁছে, প্রায়ান্ধকার গলিতে পাওয়া গেল বৃদ্ধাকে। এক কামরার চিলতে ঘরে তাঁর নিবাস। আধ ঘণ্টা পরপর কেউ এসে রুটি বা জল দিয়ে যাচ্ছেন। সেই সময়ে চ্যানেলের আজকের মতো বাড়বাড়ন্ত ছিল না বলে অনেক ক্ষণ টানা বসে কথা বলা গিয়েছিল। “যখন ৮ মাস বয়স তখন জ়ারিন (মুশারফের মা), পারভেজ়কে আমার কোলে তুলে দিয়েছিল। বলেছিল, একে তুই মানুষ কর। আমারই বা বয়স তখন কত হবে, বছর চোদ্দ। ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওকে নজরছাড়া করিনি কখনও। যখন চলে যায় মুশারফের বয়স ৪ বছর”, এক নিঃশ্বাসে সে দিন জানিয়েছিলেন আনারো। তার পর আর দেখা হয়েছে? “বছর চারেক আগেই এসে আমাকে অনেক কাপড় দিয়ে গেল। বলল, তোমার দোয়া চাই।”

২০০১ সালে আগরা সম্মেলনের সময়ে দিল্লির জন্মভিটেয় এসেছিলেন পারভেজ়। এই কুলফিওয়ালা গলির পোশাকি নাম এখন প্রতাপগড় রোড। আগে নাম ছিল কুচা সাদুল্লা খান রোড। ওখানেই এই নেহারওয়ালি হাভেলি ছিল মুশারফের দাদু কাজি মুসতাসুদ্দিনের। সেই হাভেলি ৮ ভাগ হয়ে বিক্রি হয়ে গিয়েছে দেশভাগের পরেই। শুধু কাপড় বা সালোয়ার স্যুটই নয়, সে বার এসে ২০০ ডলার দিয়েছিলেন মুশারফ তাঁর ধাই মা-কে। ওই গলির দু’ধারের সারি দেওয়া দর্জি আর পানের দোকানের কর্মীরা সে বার রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়েছিলেন মুশারফ এবং তাঁর মা জ়ারিনকে। প্রায় কুড়ি মিনিট তিনি ছিলেন সে বার সেই হাভেলিতে।

পারভেজ়ের সেই সফরে আনারোর আশা পূর্ণ হয়নি। আজ পারভেজ় মুশারফের মত্যু সংবাদ পেয়ে এক বার চক্কর লাগিয়েছিলাম সেই কুলফিওয়ালা গলিতে। না, আনারোকে খুঁজে পাওয়া যায়নি আর। সে বার যাঁরা পারভেজ়কে কাছ থেকে দেখেছিলেন, একসঙ্গে কেক ভাগ করে খেয়েছিলেন, তাঁদের কাউকেই না। পারভেজ়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই ঘিঞ্জি গলিতে তাঁর জন্মভিটের রূপকথাও সমাহিত হয়েছে সম্ভবত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement