সিআরপি-র প্রাক্তন প্রধান কুলদীপ সিংহ। ছবি: সংগৃহীত।
মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের সরকার জানিয়েছিল, সংবিধানের ৩৫৫ নম্বর অনুচ্ছেদ মেনে রাজ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ রাজ্যের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা সিআরপি-র প্রাক্তন প্রধান কুলদীপ সিংহ জানান, রাজ্যে মোটেই ৩৫৫ নম্বর অনুচ্ছেদ জারি করা হয়নি। রাজনীতিকদের মতে, সামনেই কর্নাটক ভোট। তার আগে ‘ডাবল-ইঞ্জিন’ সরকার চালিত রাজ্য মণিপুরে ৩৫৫ ধারা জারি হলে মুখ পুড়তে পারে বিজেপির। সে জন্যই এই বিবৃতি দিতে বলা হয়েছে কুলদীপকে।
মেইতেইদের জনজাতিকরণ নিয়ে হাই কোর্টের নির্দেশ ও তার বিরুদ্ধে কুকিদের প্রতিবাদ মিছিলের জেরে হিংসা ছড়িয়েছে মণিপুরে। কুলদীপকে রাজ্যে পাঠানো, এডিজিপি আশুতোষ সিংহকে আইন-শৃঙ্খলার সার্বিক ভার দেওয়া, সেনা নামানো ও দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়ার পরেই খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে বলা হয়েছিল রাজ্যে ৩৫৫ নম্বর অনুচ্ছেদ জারি করা হয়েছে। পরে ডিজিপি পি ডঙ্গেলও সাংবাদিকদের বলেছিলেন মণিপুরে ওই অনুচ্ছেদ মেনে কাজ করছে কেন্দ্র। কিন্তু বাকি সব নির্দেশের সরকারি নির্দেশনামা প্রকাশ করা হলেও ৩৫৫ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে কোনও নির্দেশনামা প্রকাশ করা হয়নি। রাজনীতিকদের মতে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরে কুলদীপের এই ঘোষণায় বোঝা গেল, বিজেপি মণিপুর নিয়ে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না- এই নীতি নিয়ে এগিয়েছিল।
রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্র লুঠ হওয়া প্রসঙ্গে কুলদীপ জানান, লুঠ হওয়া অস্ত্রের সংখ্যা কয়েকশো। তার মধ্যে বেশ কিছু আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রও রয়েছে। সংঘর্ষের সময়ে ও প্রতিবাদ মিছিলে অনেকের হাতেই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত মাত্র ৬টি কার্বাইন ও একটি ইনস্যাস উদ্ধার করতে পেরেছে পুলিশ।
এর মধ্যেই ১৯৯২ সালের আইএএস বিনীত জোশীকে রাজ্যের নতুন মুখ্যসচিব হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হল। রবিবার অপর তিন সিনিয়র আইএএস এমএইচ খান (১৯৮৮), মোজেস চাল্লাই (১৯৯০) ও পি ভাইফেই (১৯৯১)কে টপকে বিনীতকে দিল্লির ডেপুটেশন থেকে জরুরি ভিত্তিতে রাজ্যে ফিরিয়ে মুখ্যসচিব করা হয়েছে। বিনীত আগে মুখ্যমন্ত্রী বীরেনের প্রধান সচিব হিসেবে কাজ করেছিলেন।
এ দিকে সব সম্প্রদায়ের কাছে শান্তি বজায় রাখা, শৃঙ্খলা ফেরানোর অনুরোধ রেখেছেন মণিপুরের রাজ্যপাল অনুসূয়া উইকি। রাজ্যের আর্চবিশপ ডমিনিক লুমোনও সকলের কাছে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আবেদন রাখেন। তিনি বলেন, যে ভাবে মানুষের ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়েছে, রেহাই পায়নি ধর্মস্থান, মানুষ গৃহহীন হয়ে আশ্রয় শিবিরে মাথা গুঁজেছেন- তা হৃদয়বিদারক। তিনি মণিপুর সরকারের কাছে অনুরোধ জানান, যেন সব ধর্মস্থান ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চত করা হয়। খ্রিস্টান নেতারা গত রাতে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের সঙ্গে বৈঠক করেন। আজ মণিপুরে যে ভাবে একের পর গির্জায় আক্রমণ চলছে তার বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ৪৪টি গির্জা ও দেশের বিভিন্ন খ্রিস্টান সংগঠনের যৌথ মঞ্চ। তাদের বক্তব্য, গোষ্ঠী সংঘর্ষ আদতে রাজনৈতিক মদত ও পরিকল্পনাপুষ্ট হিংসার নামান্তর। এও এক ধরনের সন্ত্রাস। প্রশাসন দেখামাত্র গুলির নির্দেশ, ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ দিলেও হিংসায় পুরোপুরি রাশ টানা যাচ্ছে না। ভারতে নানা ভাষা, নানা ধর্মের সহাবস্থান। সেখানে মণিপুরের মতো ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। তারা জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়েছে, যেন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে ধর্মস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয় এবং ধ্বংস হওয়া গির্জাগুলি ফের তৈরির জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়।
গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে নতুন করে বড় কোনও সংঘর্ষ হয়নি। তবে সশস্ত্র হামলার গুজব রটায় ইম্ফলের কোংবা উচেকন খুনোউ এলাকায় অনিলকুমার নামে এক বনকর্মী মত্ত অবস্থায় দোনলা বন্দুক নিয়ে রাস্তায় নেমে গুলি চালাতে থাকেন। তাঁকে থামাতে জড়ো হয়েছিলেন এলাকাবাসী। কিন্তু অনিলের গুলিতে মারা যান জাতীয় পর্যায়ের হকি খেলোয়াড় লইশরাম রিভাল্ডো। পরে অনিল বন্দুক-সহ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
অবশ্য মণিপুরের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও খুনোখুনির মধ্যেও চূড়াচাঁদপুরে কুকি মহিলারা যে ভাবে কুকি হামলাকারীদের সামনে মানবশৃঙ্খল তৈরি করে মেইতেইদের সেনার গাড়িতে নিরাপদে ওঠার রাস্তা করে দিয়েছিলেন সেই ভিডিয়ো এখন ভাইরাল। একই ভাবে মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কুকি ছাত্রীদের উপরে হামলা করতে আসা ছাত্রদের ঠেকিয়েছেন মেইতেই ছাত্রীরা।
মণিপুরে অশান্তির মধ্যেই মেইতেইদের জনজাতিকরণের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন বিজেপির বিধায়ক তথা হিল এরিয়া কমিটির চেয়ারম্যান ডিংগাংলুং গাংমেই। তাঁর দাবি, মেইতেইরা বরাবর সংখ্যাগুরু ও শাসক সম্প্রদায়। তাঁরা কোনওভাবেই তফসিলভুক্ত জনজাতি হওয়ার দাবিদার হতে পারে না। গৌহাটি হাই কোর্ট মেইতেইদের জনজাতি হওয়ার সুপারিশ করে রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রকে প্রস্তাব পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে কুকিদের মিছিল থেকেই সাম্প্রতিক অশান্তির সূত্রপাত। অশান্তির মধ্যেই আবারও মেইতেইদের জনজাতিকরণের দাবির বিরুদ্ধে বিজেপি নেতা সুপ্রিম কোর্টে মামলা করায় অশান্তি ফের মাথাচাড়া দেওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হাই কোর্ট ওই অশান্তির জন্য বিজেপির ওই বিধায়ক ও জনজাতি ছাত্র সংগঠনের চেয়ারম্যানকে তলব করেছিল। কিন্তু হাই কোর্টের সেই তলবের বিরুদ্ধেও আবেদন জানিয়ে ডিংগাংলুং বলেন, মণিপুরে যে অশান্তি চলছে তা রাজনৈতিক। তার রাজনৈতিক ভাবেই সমাধান করতে হবে। এর পিছনে তাঁদের কোনও হাত নেই। উল্টে তিনি সুপ্রিম কোর্টে জানান, হাই কোর্টের ওই ধরনের অবিবেচক নির্দেশের ফলেই রাজ্যে অশান্তি ছড়িয়েছে ও এতগুলি প্রাণ গিয়েছে।
রাজ্যের ছ’টি ছাত্র সংগঠন একজোট হয়ে সব সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানিয়েছে, যেন সব উপদ্রুত এলাকা থেকে নিরাপদে সকলকে উদ্ধার করতে দেওয়া হয়। উত্তর-পূর্ব ছাত্র সংগঠন নেসো জানিয়েছে, বাইরের ছাত্রছাত্রীদের মণিপুর থেকে ফিরিয়ে আনার সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তারা কেন্দ্রীয় বিমান মন্ত্রককে ছাত্রছাত্রীদের উদ্ধারের জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করতে বলেছে।
সেনাবাহিনী জানায়, তারা এ পর্যন্ত ২৩ হাজার মানুষকে উদ্ধার করেছে। শনিবার থেকে অভিযান চালিয়ে আসাম রাইফেলস রবিবার দুপুরে ৬৭৬ জন নাগাকে নিরাপদে উদ্ধার করে আনে। নতুন করে অশান্তি না হওয়ায় রবিবার সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চূড়াচাঁদপুরে কার্ফু শিথিল করা হয়েছিল। তবে কপ্টারে ও ড্রোনের সাহায্যে আকাশপথে নজরদারি ও রাস্তায় সেনার ফ্ল্যাগমার্চ চলছে।