Ayodhya Ram Mandir

রানওয়ের ধুলোতেও রাম, অযোধ্যাগামী বিমান প্রায় মন্দির, রামগানও শুনল আনন্দবাজার অনলাইন!

অযোধ্যায় এসে দিনরাত রামনাম শোনার প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু কলকাতা থেকে অযোধ্যা বিমান সফরও যে রামময় হয়ে উঠবে, ভাবা যায়নি। নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন বিমানবন্দরে নেমে দেখা গেল ভক্তির অন্য রূপ।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

অযোধ্যা শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৪ ২০:১০
Share:

অযোধ্যায় বিমান থেকে নামার পরে তৈরি হল নতুন দৃশ্য। একে একে ভক্তেরা নামছেন আর নতুন বিমানবন্দরের মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করছেন। —নিজস্ব চিত্র।

বিমানে সবে ঘোষণা হয়েছে— আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই অযোধ্যার মহর্ষি বাল্মীকি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ। বিপুল ধ্বনিতে স্লোগান উঠল— ‘জয় শ্রীরাম’।

Advertisement

কান অনেক আগে থেকেই অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বুধবার কলকাতা থেকে অযোধ্যা সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সেই বিমানের পুরোপুরি দখল রামভক্তদের হাতে। কলকাতা বিমানবন্দর থেকেই সেটা মালুম হয়েছিল। গেরুয়াধারী, পাগড়ি মাথায় মহিলা-পুরুষ বোর্ডিংয়ের লাইনে দাঁড়িয়ে। বিমানে উঠেই তাঁরা শুরু করে দিলেন রামগান। ভজনের সঙ্গে রামচরিত মানস। হনুমান চালিশাও। বিমানসেবিকা তখন নিয়মমাফিক নিরাপত্তার নির্দেশ শোনাচ্ছেন। কিন্তু সে সব কিছু শোনা যাচ্ছে না রামগানের মাহাত্ম্যে।

না জানা থাকলে যে কেউ মনে করতেই পারেন অযোধ্যাগামী বিমান নয়, বরযাত্রী চলেছে। মাঝ আকাশে প্রসাদ বিতরণ থেকে গলা মিলিয়ে জয়ধ্বনি সবই হল। শুধু ধূপধুনোটুকুই বাকি ছিল। বিমান থেকে নামার পরে তৈরি হল নতুন দৃশ্য। একে একে ভক্তেরা নামছেন আর নতুন বিমানবন্দরের মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করছেন। কেউ কেউ তো সাষ্টাঙ্গে। অনেকে সিমেন্টের গুঁড়ো দিয়েই কপালে তিলক কাটলেন।

Advertisement

এটা কেন? উত্তর দিলেন কালীঘাটের মেয়ে কিন্তু অযোধ্যার বৌমা। দীপা ওয়াধওয়ানি হাজরার অদূরে খালসা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। বাবার ছিল ইটের ব্যবসা। চার দশক আগে কলকাতার এই কন্যা বৌ হয়ে এসেছিলেন অযোধ্যায়। ১৯৯২ সালে করসেবকদের সেবাও করেছেন। আলাপ বিমানে ওঠার আগেই। বিমান থেকে নেমে দীপা গাড়ির অপেক্ষায় ছিলেন অযোধ্যা বিমানবন্দরের বাইরে। ভূমি-প্রণামের ছবি তুলতে দেখে এগিয়ে এসে স্পষ্ট বাংলায় বললেন, ‘‘এখানে একটা গান খুব গাওয়া হয়। চন্দন হ্যায় ইস দেশ কি মাটি, তপভূমি সব গাঁও হ্যায়, হর বালা হ্যায় দেবী কি প্রতিমা, বাচ্চা বাচ্চা রাম হ্যায়।’’ সুর দিয়ে শোনালেনও। তার পরে অল্প হেসে বললেন, ‘‘এই ভূমির সব শিশুই রাম আর সব ধূলিকণাই চন্দনের মতো পবিত্র।’’

চারপাশে তাকিয়ে মনে হল, নতুন কোনও শহর তৈরি হচ্ছে। চারদিকে ধূ ধূ মাঠ। বিমানবন্দর বলতে যা বোঝায়, আদৌ তা নয়। দ্বিতীয়ায় শুরু করে ষষ্ঠীতে দুর্গাঠাকুর মণ্ডপে এসে যাবে বলে যেমন প্যান্ডেল হয় তেমন। সোমবার রামমন্দিরের উদ্বোধন। দেশ-বিদেশের অতিথিরা তো এই পথেই রামভূমে ঢুকবেন! তবে এটাই হয় তো শাস্ত্রের বিধান— অসম্পূর্ণ মন্দির উদ্বোধনের জন্য অসম্পূর্ণ বিমানবন্দর।

৩০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিমানবন্দরের উদ্বোধন তো করে দিয়েছেন। কিন্তু মন্দির তৈরির চার দিন আগেও পুরোপুরি তৈরি হয়নি বাল্মীকি বিমানবন্দর (ডাকনাম)। তাতে কী! হইচই, ঢাকঢোলের অভাব নেই। তখনই দিল্লি থেকে আসা বিমানে এসেছেন এক সন্ত। ভক্তেরা ফুল, মালা, গাড়ি নিয়ে এসেছেন। বিমানবন্দর থেকে অযোধ্যা শহর গাড়িতে আধ ঘণ্টার রাস্তা। ৩৩০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ১১ কিলোমিটার পথ। নামে অযোধ্যা বিমানবন্দর হলেও আদতে জায়গাটা ফৈজাবাদে। তবে স্থানীয়েরা সেটা মানতে নারাজ। অযোধ্যাগামী গাড়ির সারথি ভিকি যাদব বললেন, ‘‘আভি সব অযোধ্যা হো গ্যয়া! সব রামজি কি এরিয়া।’’ এটা কি দখলের মনোভাব? হতেও পারে। একটা সময়ে অযোধ্যা ছিল ফৈজাবাদ জেলার একটি শহর। আর এখন ফৈজাবাদই অযোধ্যা জেলার একটি শহর। বিজেপি জমানায় জন্ম নেওয়া সেই জেলার উত্তরে গোন্ডা আর বস্তি জেলা। দক্ষিণে অমেঠি আর সুলতানপুর।

তবে জেলার গর্ব বাড়িয়ে দিয়েছে এই বিমানবন্দর। শুরুটা হয়েছিল অখিলেশ যাদবের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ে। কেন্দ্রের সঙ্গে কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু জল বেশি দূর গড়ায়নি। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যখন ঠিক হয়ে গেল ‘মন্দির ওহি বনেগি’, তখন থেকেই জলপ্রপাতের গতিতে জল গড়াতে শুরু করে। ২০২২ সালের এপ্রিলে সিদ্ধান্ত আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে উদ্বোধন! দ্রুততম বিমানবন্দর নির্মাণের জন্যও কোনও রেকর্ড গড়া হয়ে গেল কি না কে জানে!

তবে এটা প্রথম পর্বের বিমানবন্দর। আপাতত তিনটি টার্মিনাল নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। অযোধ্যাবাসীর আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে, রামমন্দিরের থেকেও বড় পাওনা বিমান যোগাযোগের সূচনা। উত্তরপ্রদেশে অনেক বিমানবন্দর। কিন্তু রামভূমেই তা ছিল না। অযোধ্যায় রাম তো ছিলেনই, এখন ধনী রামভক্তেরাও আসবেন। শহরের নয়াঘাটের ব্যবসায়ী ধর্মেন্দ্র সিংহ যেমন বললেন, ‘‘এত দিন এখানে বেশি আসতেন দেহাতি মানুষ। ভিড় হত। কিন্তু সেই ভিড়ে উপার্জন কম ছিল। এখন এত হোটেল-বাজার হয়েছে। ট্রেনেও অনেক মানুষ আসবেন। কিন্তু বাজার আসবে বিমানে চেপেই।’’

একটা সময়ে ঠিক হয়েছিল, রামের নামেই নাম হবে বিমানবন্দরের। পরে রামের সৃষ্টিকর্তার নাম ভাবনায় আসে। রাম আর হনুমানের কাহিনি দিয়ে সাজানো বিমানবন্দরের নামের সঙ্গে একটু হলেও উচ্চারিত হবে মহর্ষি বাল্মীকির নাম। রামভক্তদের কাছে বাল্মীকির চেয়ে তুলসীদাস বেশি কাছের।

কিন্তু রামায়ণের রচনাকার বাল্মীকির নামই কি কারণ? না কি এই নামকরণেও রয়েছে ভোটের চিন্তা? উত্তরপ্রদেশে দলিত সম্প্রদায় মোট ৬৫টি জনজাতিতে বিভক্ত। সেই জনজাতিদের একটা অংশের নাম ‘বাল্মীকি’। এই ভোট এক সময়ে মায়াবতীর ‘হাতি’ চিহ্নে পড়ত। এখন বেশিটাই নাকি পদ্মের। অযোধ্যার বিজেপি নেতা সঞ্জয় কৌশল বলছিলেন, ‘‘বাল্মীকিরা মনে করেন রামায়ণ রচয়িতা মহর্ষিও তাঁদেরই সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। এ নিয়ে তাঁদের গর্বও রয়েছে। তবে এমনটাও শোনা যায় যে, বাল্মীকি আসলে ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান।’’

‘ভোটার বাল্মীকি’ এবং ‘মহর্ষি বাল্মীকি’ নিয়ে উত্তরপ্রদেশে অনেক রাজনৈতিক টানাটানি রয়েছে। তা নিয়ে পারস্পরিক লড়াই অনেক সময়ে দস্যু রত্নাকরকে মনে করিয়েছে। তবে ‘রত্নাকর’ থেকে ‘বাল্মীকি’ হয়ে ওঠা মহর্ষিও এখন বিজেপির ঝুলিতে। আগামী সোমবার যে নতুন রামায়ণ লিখতে চলেছেন মোদী-যোগীরা, তাতে তিনি দর্শক। অনেকে বলছেন, মকর সংক্রান্তিতে অযোধ্যাবাসী ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব করলেও এ বার সেটাও হবে ২২ জানুয়ারি। আর হবে বিমানবন্দরে। ঠিক কতগুলো চাটার্ড বিমান নামবে সে দিন, তা নিয়ে তর্কও চলছে। কেউ বলছেন ১০০টা। কেউ বলছেন ১১০টা। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জানিয়েছেন, শতাধিক বিমান উঠবে-নামবে। ছোট বিমানবন্দরে সব বিমানের ঠাঁই হবে না। সওয়ারি নামিয়ে চলে যাবে, আবার নিতে আসবে সময় মতো। তার নাকি ‘রস্টার’ও তৈরি হয়ে গিয়েছে।

ভিকির মতো ট্যাক্সিচালক বা আরও অনেকের অবশ্য সোমবার রামমন্দিরের উদ্বোধন দেখার সুযোগ থাকবে না। ভিকি ঠিক করেছেন বিমানবন্দরেই চলে যাবেন। আকাশে তাকিয়ে দেখবেন পেটকাটি, চাঁদিয়াল, মোমবাতি, বগ্গার মতো নানা রঙের বিমান। ঘুড়ির মতো ভাসবে। নামবে। উঠবে। নব রামায়ণের রচনা দেখবেন ‘বিমানবন্দর বাল্মীকি’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement