গল্ফ কার্টে ধনমণি বরা (মাঝখানে)। নিজস্ব চিত্র।
হাতে মাত্র ৬ দিন। তারপর থেকেই নতুন দায়িত্ব, নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে। আর যাত্রীর আশায় রাস্তায় দিনভর অপেক্ষা নয়। একেবারে বিধানসভা চত্বরে, খোদ বিধায়কেরাই তাঁর যাত্রী হবেন!
নারী দিবসে, অসম বিধানসভা ভবনে, নতুন ব্যাটারিচালিত গল্ফ কার্টে বসে ধনমণি বরা বলছিলেন, “নারী দিবস বলে কোনও দিনের কথা আলাদা করে তখন মাথায় ছিল না। থাকা সম্ভবও নয়। বিভিন্ন কারণে স্বামীর ঘর ছেড়ে দুই বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। নারীর সম্মান দূরের কথা, একলা মেয়ের সমাজে বেঁচে থাকা যে কত কষ্টকর- তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলাম।” একাকিনী ধনমণির পক্ষে সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ধারদেনা করে কিনেছিলেন ই-রিক্সা। গুয়াহাটি তথা অসমে তিনিই প্রথম মহিলা ই-রিক্সা চালক। পরিবার-প্রতিবেশীর অনেক অবিশ্বাস, তাচ্ছিল্য উড়িয়ে দিয়ে, ২০১৯ সালের ৮ মার্চ তিনি হাতিগাঁও এলাকায় ই-রিক্সা চালানো শুরু করেছিলেন। কাকতালীয় ভাবেই দিনটা ছিল নারী দিবস।
মহিলা ই-রিক্সা চালক মানুষের নজর যত সহজে আকর্ষণ করে, রোজগার কিন্তু তত সহজে হয় না— জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছিলেন ধনমণি। তাঁর কথায়, ‘‘আমাকে নিয়ে কানাঘুষো হত, আমার ই-রিক্সায় যাত্রী তত হত না। অবশ্য মহিলারা নির্ভয়ে আমার রিক্সা বেছে নিতেন। অন্যান্য পুরুষ ই-রিক্সা চালকদের সঙ্গে লিঙ্গ বৈষম্যের চাপা লড়াই তো ছিলই।”
কিন্তু জমি ছাড়েননি ধনমণি। বলেন, “হাল ছাড়লে তো ভেসে যেত সংসার। শেষ পর্যন্ত টিঁকেও গিয়েছি এই লাইনে।”
গত বছর করোনার টিকাকরণ যখন চলছে, তখন ধনমণির ই-রিক্সা হয়ে উঠেছিল কোভিড সহায়তার অন্যতম প্রতীক। সিনি সংস্থার উদ্যোগে রাজ্যের প্রথম কোভিড সহায়তা কেন্দ্র তৈরি হয় দিসপুরে, সচিবালয়ের পাশেই। সেখানো যোগ দেন ধনমণি। কোভিডের টিকা নিতে অনিচ্ছুক বা টিকাকেন্দ্রে আসতে অপারগ ব্যক্তিদের কাছে টিকা পৌঁছে দেওয়ার ‘রথ’ হয়ে ওঠে সারথি ধনমণির ই-রিক্সা। দিনভর আশাকর্মী বা নার্সদের নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেছেন তিনি। তাঁর ই-রিক্সাই হয়ে উঠেছে চলমান কোভিড টিকাকরণ কেন্দ্র। ধনমণি জানান, সাড়ে ৬ মাস কোভিড সহায়তা কেন্দ্রের যুক্ত থাকার সময় অন্তত ৫০০০ মানুষের বাড়ি গিয়ে টিকাকরণের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর ই-রিক্সা সাজিয়ে তোলা হয়েছিল টিকাকরণের বার্তায়।
আদতে মঙ্গলদৈয়ের বাসিন্দা ধনমণির কথা জানতে পেরে তাঁকে দেখা করতে ডাকেন বিধানসভার স্পিকার বিশ্বজিৎ দৈমারি। পরিকল্পনা হয়, বিধানসভার ভিতরে গাড়ি চলাচল কমাতে ও দূষণ কমানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে চারটি গল্ফ কার্ট। তারই একটি গাড়ি চালানোর ভার দেওয়া হয় ধনমণিকে। বিশ্বজিৎবাবু আরও সিদ্ধান্ত নেন, বাকি তিনটি গাড়িও চালাবেন মহিলারাই। সেই দায়িত্ব নিয়ে, পানেরি থেকে আসা জোনাটি রাভা, তুলিকা রাভা, প্রিয়ঙ্কা ডেকারা সকলেই কোনও না কোনও ভাবে গাড়ি চালানো শিখেছিলেন। বিধানসভায় ঢোকাটাই তাঁদের কাছে স্বপ্ন ছিল। তাই বিধানসভায় বিধায়কদের যাত্রী হিসেবে আনা-নেওয়া করানোর প্রস্তাবে রাজি হতে দেরি করেননি। জোনাটির বাড়িতে ১১ বছরের মেয়ে আছে। তুলিকাও বিবাহিতা। সকলের কাছে ধনমণিই এখন বলতে গেলে স্থানীয় অভিভাবক। চার রমণী আপাতত বিধানসভার ভিতরে গল্ফ কার্ট চালানো রপ্ত করছেন। ১৪ মার্চ বিধানসভার বাজেট অধিবেশন শুরু। সেই দিন থেকেই কাজ শুরু হবে তাঁদের।
ধনমণি জানান, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিধানসভার গাড়ি চালানোর পরে সন্ধ্যায় নিজের ই-রিক্সা নিয়ে বার হবেন। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। তাই যত কষ্টই হোক, রোজগারে আলগা দেওয়া যাবে না! তাঁর সংসারে ৩৬৫ দিনই নারী দিবস।