আদর্শ নিয়ে জঙ্গিদের মধ্যে সংঘাত এখন তুঙ্গে। গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ
গোটা উপত্যকা জুড়ে জিহাদিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে। বিরোধ এতটাই যে, এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীকে খুন করতেও পিছপা নয়। শুধু তাই নয়, জিহাদিদের একাংশ আবার খোদ পাক গোয়েন্দা সংস্থার মাতব্বরির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছে।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ এবং রাজ্যের স্বীকৃতি খর্ব হওয়ার ফলে জম্মু-কাশ্মীরে বড়সড় গন্ডগোলের আশঙ্কা করছেবিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু এ দেশের একাধিক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্তার ইঙ্গিত, উপত্যকায় জিহাদের ঘোলা জলকে কাজে লাগিয়েই তার শিকড় কাটতে ছক কষছে ‘ডোভাল ব্রিগেড’।
যদিও গোয়েন্দারা সতর্ক। এক গোয়েন্দা কর্তা বলেন, ‘‘পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই পাল্টা আঘাত হানার মরিয়া চেষ্টা করছে। সে কারণেই দেশের ১৯টি বিমান বন্দরকে সতর্ক করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের আগে হামলা করে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবে পাক মদতে তৈরি সংগঠনগুলো। বিশেষ সতর্কতা নেওয়া হয়েছে কলকাতা বিমানবন্দরেও।’’ কিন্তু আইএসআই সংক্রান্ত এই আশঙ্কাকে বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি নন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।
জঙ্গিদের অন্তর্দ্বন্দে খুন আদিল খানের শেষকৃত্যে আই এস পতাকা — ছবি সংগৃহীত
ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্রে খবর, তাঁরা কাশ্মীরে সক্রিয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। এক, সরাসরি পাক গোয়েন্দা সংস্থার মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠন। দুই, আইএস মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং সাহায্য প্রাপ্ত জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট ইন হিন্দ প্রভিন্স (আইএসএইচপি)এবং তিন, আল-কায়দার মতাদর্শে বিশ্বাসী আনসার গাজওয়াতুল হিন্দ।
আরও পড়ুন- ৩৭০ ধারা রদ, জাতির উদ্দেশে ভাষণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর
কাশ্মীর উপত্যকায় গত শতাব্দীর নয়ের দশক থেকে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন হরকত উল মুজাহিদিন (হুম)। ওই সংগঠন কোনও ধরনের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ অস্বীকার করে। কাশ্মীরের মানুষদের নিয়েই তৈরি তাদের সংগঠন, এমনটাই দাবি করে তারা। কিন্তু গোয়েন্দাদের দাবি, হুম-এর প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে তাদের পরিচালনা—সবটাই করে পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। হুম ছাড়াও, উপত্যকায় একাধিক বড় জঙ্গি হানার ক্ষেত্রে উঠে এসেছে পাকিস্তানের মাটিতে তৈরি হওয়া দুই সংগঠন লস্কর-এ-তৈবা এবং জইশ-ই-মহম্মদের নাম। গোয়েন্দাদের দাবি, ওই দুই সংগঠনই আসলে আইএসআই-এর ছায়া সংগঠন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি, হুম, জৈশ এবং লস্কর— তিনটি সংগঠনই পরিচালিত হয় পাকিস্তানের মাটি থেকে। সে কারণেই ভারত বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাশ্মীরের জঙ্গি কার্যকলাপকে ‘স্পন্সরড টেরোরিজম’ বলে অভিহিত করেছে।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের একটি অংশের দাবি, গত কয়েক বছরে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে কাশ্মীর উপত্যকায় জিহাদের সমীকরণ। গত দু’বছর ধরে গোটা উপত্যকাতেই প্রভাব বাড়িয়েছে আইএস। প্রতি শুক্রবারের নমাজের পর উপত্যকার বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায় আইএসের কালো পতাকা। সেই প্রভাব কাজে লাগিয়েই কাশ্মীরের বুকে তৈরি হয়েছে আইএস ইন হিন্দ প্রভিন্স। আইএস-র আগে থেকেই উপত্যকায় আনসার গাজওয়াতুল হিন্দ নামে কাশ্মীরকেন্দ্রিক নতুন সংগঠন তৈরি করে আল কায়দা।
ওই সংগঠনের কমান্ডার জাকির মুসা ও তার বাহিনী এক সময়ে গোটা উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনীর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। হরকত উল মুজাহিদিন জঙ্গি বুরহান ওয়ানির ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাকির রশিদ বাট ওরফে জাকির মুসা আদর্শগত কারণে হুম ছেড়ে যোগ দেয় আনসার গাজওয়াতুল হিন্দ-এ। কাশ্মীরে কাজ করা এক গোয়েন্দা কর্তা বলেন, ‘‘এ বছর মে মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে মুসার মৃত্যু হলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যে জন সমাবেশ হয়, তা থেকেই স্পষ্ট আল কায়দা উপত্যকার বুকে কতটা গভীরে প্রভাব বিস্তার করেছে।”
হরকত এবং লস্কর জঙ্গিদের হাতে খুন আইএস সদস্য আদিল খান — ছবি সংগৃহীত
গত জুন মাসে মুসার ডেপুটি পুলওয়ামার কাকাপোরার বাসিন্দা হামিদ লেলহারি আনসারের প্রধান হিসাবে প্রকাশ্যে আসে। একটি ভিডিয়ো বার্তায় লেলহারি পাক গোয়েন্দা সংস্থার কড়া সমালোচনা করেন। ওই ভিডিয়ো বার্তায় তিনি বলেন,‘‘পাক গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের কাছে এসেছিল সাহায্য করতে। কিন্তু তারা শর্ত দিয়েছে যে, আমরা তাদের না জানিয়ে এবং বিনা অনুমতিতে কোনও অপারেশন করতে পারব না।” তিনি ওই ভিডিয়ো বার্তায় বলেন, ‘‘আমাদের সংগঠন পাকিস্তানের হাতের পুতুল হয়ে কাজ করতে চায় না।’’ হামিদ লেলহারি ইসলামের ‘সুরা’-তে বিশ্বাসী সমস্ত সংগঠনের একটি সমন্বয় মঞ্চ তৈরি করার কথা বলেন।
হামিদের বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। কারণ, কাশ্মীরে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলির ইতিমধ্যেই একটি সমন্বয় মঞ্চ—ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিলরয়েছে। তার প্রধান হুম-এর সৈয়দ সালাউদ্দিন। সেই সংগঠনকে অস্বীকার করে নতুন সমন্বয় মঞ্চ তৈরির ডাক, হুম এবং পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলিকেই অস্বীকার করা বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।
আল-কায়দা বনাম পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনের ওই বিরোধের পাশাপাশি সামনে এসেছে হুম বনাম আইএস মতাদর্শে চলা সংগঠনের বিরোধও। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে অনন্তনাগ জেলার বিজবেহারাতে আইএসপন্থী উইলাহা হিন্দের সদস্য আদিল খানকে হত্যা করে হুম এবং লস্করের জঙ্গিরা। আদিলের সঙ্গীদের দাবি, লস্কর ছেড়ে আইএস-এ যোগ দিয়েছিল আদিল। তাই প্রতিশোধ।
গোয়েন্দাদের দাবি, নিজেদের মধ্যে জিহাদিদের এই সংঘাত উপত্যকার বিভিন্ন প্রান্তে চলছে। আইএস এবং আল কায়দা দু’পক্ষই পাকিস্তানকে এড়াতে, কাশ্মীরের জিহাদের মূল অক্ষ আফগানিস্তানে নিয়ে যেতে চাইছে। এক গোয়েন্দা কর্তা বলেন,‘‘আফগানিস্তানে আল কায়দা-পন্থী তালিবানদের সঙ্গে জোর লড়াই চলছে আইএস-এর। সেখান থেকে দু’পক্ষই চাইছে কাশ্মীরের শাখা সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করতে।”
কলকাতা বিমানবন্দরে চলছে বিশেষ তল্লাশি। নিজস্ব চিত্র
সূত্রের খবর, গত দু’দিনে অজিত ডোভাল কাশ্মীরে যে বিভিন্ন বৈঠক করেছেন, সেখানে ওই বিরোধের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। কী ভাবে ওই বিরোধকে কাজে লাগিয়ে ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা’ তোলা যায় তারই ছক কষছেন গোয়েন্দারা।
তবে শীর্ষ গোয়েন্দাদের একটি অংশ স্বীকার করেন, ‘অপারেশন কাশ্মীরের’ ফুলপ্রুফ পরিকল্পনাতে চ্যালেঞ্জ একটাই। জিহাদের পাশাপাশি, কাশ্মীরের জাতিসত্তার আন্দোলনকে রোখা। আগুনের এই ফুলকি ঠেকাতেই তাই জনসংযোগে কাশ্মীরের রাস্তায় অজিত ডোভাল।