জেসুইট পাদ্রি স্ট্যান স্বামী। ফাইল চিত্র।
ফাদার স্ট্যান স্বামীর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যে মামলা’ সাজানো, তাঁকে লাগাতার জেলে আটকে রাখা এবং ‘অমানবিক আচরণের’ জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ দাবি করলেন বিরোধী শিবিরের নেতা-নেত্রীরা। তবে কেন্দ্রের তরফে আজ বলা হয়েছে, স্বামীর বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযোগ ছিল বলেই বিভিন্ন আদালত তাঁর জামিনের আর্জি নাকচ করেছিল।
গত কাল বম্বে হাই কোর্টে জামিনের শুনানির আগেই আদিবাসীদের অধিকারের হয়ে আন্দোলনকারী জেসুইট পাদ্রি স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু হয়। আজ কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী, এনসিপি-র শরদ পওয়ার, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এম কে স্ট্যালিন, হেমন্ত সোরেনের মতো বিরোধী শিবিরের ১০ জন নেতা-নেত্রী রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখে দাবি তুলেছেন, স্বামীর সঙ্গে যারা অন্যায় করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিন।
আজ মার্কিন ফরেন্সিক সংস্থা আর্সেনাল কনসাল্টিং রিপোর্ট দিয়েছে, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত সুরেন্দ্র গ্যাডলিংয়ের ল্যাপটপে ই-মেলের মাধ্যমে ম্যালওয়ার পাঠিয়ে নানা রকম নথি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ওই সব নথি কাজে লাগানো। সুরেন্দ্রকে গ্রেফতারের আগে তাঁর ল্যাপটপ, ই-মেলেও নজরদারি চালানো হয়। এর আগে আর এক অভিযুক্ত রোনা উইলসনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে বলে আর্সেনাল আদালতে জানিয়েছিল।
আজ রাষ্ট্রপতির কাছে বিরোধীরা দাবি জানিয়েছেন, ভীমা কোরেগাঁওয়ের মতো ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলায় ‘দানবীয়’ ইউএপিএ এবং রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, এ বার কি বিচার ব্যবস্থার বিবেক কেঁপে উঠবে?
গত বছরের অক্টোবরে কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেই ৮৪ বছরের স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামী ওরফে ফাদার স্ট্যান স্বামীকে গ্রেফতার করে এনআইএ। তার আগে থেকেই তিনি পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত ছিলেন। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা বা এনআইএ তাঁকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করলেও এক দিনের জন্যও নিজেদের হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। জেলবন্দি স্ট্যান স্বামী অসুস্থতার জন্য জামিন চাইলে এনআইএ-র আইনজীবীরা জোরালো বিরোধিতা করে যুক্তি দিয়েছেন যে, বৃদ্ধ জেসুইট পাদ্রি মাওবাদীদের সঙ্গে মিলে সরকার ফেলে দেওয়ার ছক কষছেন। বিশেষ এনআইএ আদালত তাঁর জামিনের আর্জি খারিজ করে দিয়ে বলেছিল, শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও জামিন দেওয়া যাবে না। মহারাষ্ট্রের তালোজা জেলে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে স্বামী বম্বে হাই কোর্টের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু জামিনের শুনানির আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভারের অভিযোগ, “এটাই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হবে। তার পরে জামিনের বিরোধিতা করে আটকে রাখা হবে। কিন্তু কী কারণে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল, তা ফৌজদারি আইনি ব্যবস্থাকে ভাবতে হবে। কারণ এই ব্যবস্থাটাই ফাদারকে মেরে ফেলেছে। এই ঘটনায় বিচার ব্যবস্থার বিবেক কেঁপে ওঠা উচিত।” ভীমা কোরেগাঁও মামলায় মোট ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছিল এনআইএ। স্ট্যানের মৃত্যুর পরে আজ বাকি অভিযুক্তদের পরিবার-পরিজনেরা বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এক ‘নিষ্ঠুর রাষ্ট্র’ দ্বারা সংঘটিত ‘প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকাণ্ড’। প্রবীণ আইনজীবী কলিন গঞ্জালভেসের অভিযোগ, “সরকারি পক্ষ চেয়েছিল, স্বামী জেলে মারা যান। সে রকম ভাবেই ছক কষা হয়েছিল যাতে সমাজকর্মী ও আন্দোলনকারীদের কাছে বার্তা যায়, সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে এই ভাবেই জেলে আমৃত্যু আটকে রাখা হবে।”
কাল স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি মেরি লেলর এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার প্রতিনিধি ইমন গিলমোর। এ দিন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল বাশেলে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘‘শুধুমাত্র সমালোচনামূলক মন্তব্য করার জন্য পর্যাপ্ত আইনি ভিত্তি ছাড়া যাঁদের আটক রাখা হয়েছে, কোভিড পরিস্থিতিতে তাঁদের মুক্তি দিক ভারত ও অন্যান্য দেশ।’’ আমেরিকার আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ)-এর চেয়ারপার্সন ন্যান্ডিন মেয়েনজ়া টুইটারে লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদের ভুয়ো অভিযোগে’ জেলবন্দি করা হয়েছিল স্বামীকে।
এই পরিস্থিতিতে স্বামীর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রককে। যার উত্তরে মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জানিয়েছেন, আইন মোতাবেকই এনআইএ স্বামীকে গ্রেফতার করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযোগের কারণেই বিভিন্ন আদালত তাঁর জামিনের আর্জি নাকচ করে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আইনভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন, আইনসঙ্গত অধিকার প্রয়োগের বিরুদ্ধে
নয়। আইন মেনেই সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্বামীর অসুস্থতার কারণে বম্বে হাই কোর্ট একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসার অনুমতি দেয়। সেখানে আদালতের তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। শারীরিক জটিলতার কারণে ৫ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। অরিন্দমবাবু আরও বলেন, ভারত সরকার মানবাধিকার রক্ষায় দায়বদ্ধ। ভারতের গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থায় স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, জাতীয় এবং রাজ্য স্তরে মানবাধিকার কমিশন (যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের দিকে নজর রাখে), স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং অধিকার রক্ষায় সরব নাগরিক সমাজ রয়েছে।
দিল্লির হিংসার মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও দিল্লি পুলিশ ইউএপিএ প্রয়োগ করেছে। সম্প্রতি তিন পড়ুয়া-সমাজকর্মীকে জামিনে মুক্তি দিয়ে দিল্লি হাই কোর্ট ইউএপিএ-র অপব্যবহারের দিকে আঙুল তুলেছে। হাই কোর্টের বক্তব্য ছিল, যে কোনও অপরাধে সন্ত্রাস দমন আইন ইউএপিএ প্রয়োগ করা যায় না। যত কঠোর আইন, তার ব্যবহারে ততটাই সতর্কতা দরকার। দিল্লি পুলিশ এর বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে। প্রবীণ আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ের কথায়, “এনআইএ-র মতো সংস্থা নিজেদের অভিযোগ প্রমাণের বদলে জামিনের বিরোধিতায় বেশি নজর দিচ্ছে। ফলে বিচারাধীন অবস্থায়, দোষী প্রমাণ হওয়ার আগেই কেউ ১০ বছর জেলে আটকে থাকছেন। বস্তুত, আগেই সাজা হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে আইনের প্রক্রিয়াকেই শাস্তির প্রক্রিয়া হিসেবে কাজে লাগাতে দেওয়া হচ্ছে।”
বিজেপি নেতারা পাল্টা মনে করাচ্ছেন, ২৬/১১-র হামলার পরে মনমোহন জমানায় পি চিদম্বরম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীনই ইউএপিএ তৈরি হয়েছিল। একই সময়ে সন্ত্রাসমূলক হামলার তদন্তে এনআইএ-ও তৈরি হয়। এখন কংগ্রেসই এর বিরোধিতা করছে। স্বামীকে সমর্থনের জন্য ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনেরও সমালোচনা করেছে বিজেপি। এনআইএ কর্তাদের যুক্তি, স্ট্যান স্বামী বৃদ্ধ হলেও তাঁর সঙ্গে নিষিদ্ধ সিপিআই (মাওবাদী)-র যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে। তিনি ভীমা কোরেগাঁওতে অশান্তি তৈরির পরিকল্পনায় এলগার পরিষদের সভার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন। সেই সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখেই বিশেষ এনআইএ আদালত তাঁর জামিনের আর্জি খারিজ করেছিল। মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দারের পাল্টা যুক্তি, “কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ যাচাইয়ের আগেই ইউএপিএ-তে মামলা হচ্ছে। তার পর তা নিষ্ঠুর ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। জেল থেকে ছাড়া পেলে পার্কিনসন্সের রোগী স্ট্যান কি পালিয়ে যেতেন?”
দেশের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণার কাছে স্বামীর মৃত্যুতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানানোর জন্য আজ থেকে মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা অনলাইনে সই সংগ্রহ শুরু করেছেন। তাঁদের দাবি, ইউএপিএ, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা প্রয়োগের আইনি পর্যালোচনা হোক। এই আইনে বন্দিদের জামিনের আর্জি পুনর্বিবেচনা করা হোক।