‘দিল্লি চলো’: প্রতিবাদ মিছিলে প্ল্যাকার্ড হাতে এক কৃষক। রবিবার দিল্লির সিংঘু সীমানায়। ছবি: পিটিআই।
লোকসভা নির্বাচনের পরে ছত্রভঙ্গ বিরোধী শিবিরের দলগুলিকে এই প্রথম এক বিন্দুতে নিয়ে এল কৃষক আন্দোলন। আজ অন্তত ১৫টি রাজনৈতিক দল এক সুরে কৃষকদের ৮ ডিসেম্বরের বন্ধকে সমর্থন করেছে।
সব মিলিয়ে কার্যত একঘরে বিজেপি। কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার থেকে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে নানা মত থাকলেও কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে ভাবে প্রায় সব বিরোধী দল এক সুরে সরব হয়েছে, তাতে রীতিমতো ব্যাকফুটে নরেন্দ্র মোদী সরকার। কৃষকদের পক্ষ জানানো হয়েছে, তাঁদের আন্দোলনে সব রাজনৈতিক দলই স্বাগত। কিন্তু সেই সব দলের নেতাদের নিজেদের দলের পতাকা ফেলে কৃষকদের পতাকার তলায় দাঁড়িয়ে আন্দোলনে শামিল হতে হবে।
কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করে কোনও ফল না-হওয়ায় আগামী ৮ ডিসেম্বর ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছেন কৃষকেরা। প্রথমে মনে করা হচ্ছিল, ওই বন্ধ শুধু পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে প্রভাব ফেলবে। কিন্তু আজ বিজেপি-বিরোধী প্রায় সব দলই একযোগে কৃষকদের সমর্থন করায় কার্যত ওই বন্ধের প্রভাব পড়তে চলেছে গোটা দেশেই। আজ প্রথমে বামেদের পাশাপাশি কংগ্রেস, আরজেডি, ডিএমকে, এনসিপি, এসপি-র মতো দলগুলি বন্ধের সমর্থনে সরব হয়। পরে আপ, টিআরএস, এমআইএম, কাশ্মীরের দলগুলির গুপকর জোটও ওই বন্ধের সমর্থনে এগিয়ে আসে। নীতিগত সমর্থন জানিয়েছে তৃণমূলও।
আরও পড়ুন: কৃষকদের পাশে এ বার বিজেন্দ্র, আইন প্রত্যাহার না করলে খেলরত্ন ফেরানোর হুঁশিয়ারি
আরও পড়ুন: রাজীব গাঁধীর নাম পাল্টে গোলওয়ালকরের নামে বিজ্ঞান কেন্দ্রের নামকরণ, বিতর্কে মোদী সরকার
আজ বিরোধীদের পক্ষ থেকে কৃষকদের আন্দোলনকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, তারা ৮ ডিসেম্বরের বন্ধে সমর্থন জানাচ্ছে। সংসদে আলোচনা, ভোটাভুটি না-করে অগণতান্ত্রিক ভাবে ওই তিনটি কৃষি বিল পাশ হয়েছিল। সেগুলি প্রত্যাহার করতে হবে সরকারকে, কারণ ওই আইনগুলি এ দেশের মানুষের খাদ্যসুরক্ষা কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তুলে দিয়ে মোদী সরকার কৃষি ব্যবস্থাকে দেশীয় পুঁজিপতিদের বন্ধকিতে পরিণত করতে চলেছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। বিবৃতিতে সই করেছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, এসপি নেতা অখিলেশ যাদব প্রমুখ। বিরোধীদের মধ্যে একমাত্র বিএসপি বন্ধে সমর্থন জানায়নি। আবার এনডিএ শরিক অসম গণ পরিষদ বন্ধে সায় না-দিলেও কৃষকদের উদ্বেগের বিষয়গুলিকে সমর্থন জানিয়েছে।
আজও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, বিরোধী দলগুলির প্ররোচনার শিকার হচ্ছেন কৃষকেরা। তাঁদের ভুল বোঝানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কৃষি প্রতিমন্ত্রী কৈলাস চৌধুরির কথায়, “কৃষকদের বোঝা উচিত, রাজনৈতিক ফায়দার জন্যই তাঁদের ব্যবহার করা হচ্ছে।’’ বিজেপি সূত্রের মতে, কৃষকদের অন্যতম দাবি ছিল, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বজায় রাখা। কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর গত কাল ফের তা বজায় রাখার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু অল ইন্ডিয়া কিসান সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি আজ ফের স্পষ্ট করে দিয়েছে, কৃষি সংক্রান্ত তিনটি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তারা অনড়।
পরশুর বন্ধকে সফল করতে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন কৃষকেরা। আজ দুপুরে নয়ডার রাষ্ট্রীয় দলিত প্রেরণাস্থল থেকে দিল্লির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করেন ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন লোক শক্তির সদস্যেরা। যদিও দিল্লিতে প্রবেশের বহু আগেই তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। কৃষকদের আটকাতে কার্যত দুর্গে পরিণত হয়েছে গোটা দিল্লি। রাজধানীর যে বাসিন্দারা কাজের সূত্রে হরিয়ানা বা উত্তরপ্রদেশে যান, তাঁদেরও যাতায়াতের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে প্রশাসন। আন্দোলনকারী কৃষকেরা জানিয়েছেন, চণ্ডীগড়, রোহতক, মেরঠ, মথুরা থেকে দিল্লিগামী চারটি জাতীয় সড়ক ধরে আরও কৃষক রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছেন। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা এমনকি প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাত থেকেও আসছেন। কৃষক নেতা শিবকুমার কাকার দাবি, অন্তত পাঁচশো ট্রাক্টর এই মুহূর্তে মধ্যপ্রদেশ থেকে দিল্লির দিকে এগোচ্ছে।
যে ভাবে কৃষক আন্দোলনের ঢেউ গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ে কেন্দ্রকে সতর্ক করে দিয়ে প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রী তথা এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার বলেছেন, “দশ দিনের বেশি সময় ধরে কৃষকেরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের উচিত দ্রুত আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া। কারণ এর পরে কৃষকদের বিক্ষোভ আর দিল্লিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ক্রমশ সারা দেশের কৃষক, এমনকি সাধারণ মানুষও তাঁদের সমর্থনে নেমে পড়বেন।” কৃষকদের আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে কয়েক দিনের মধ্যেই দিল্লি আসছেন শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে। হরিয়ানা ও দিল্লির সিংঘু সীমানায় আজ বিক্ষোভরত কৃষকদের পাশে দাঁড়ান বক্সার বিজেন্দ্র সিংহ। সরকার আইন প্রত্যাহার না-করলে তিনি দেশের সর্বোচ্চ ক্রীড়া সম্মান রাজীব গাঁধী খেলরত্ন পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবি ও বন্ধের সমর্থনে দিল্লির যন্তরমন্তরে আগামিকাল ধর্না দেবেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। পরশু বিকেল তিনটে পর্যন্ত সব দোকান বন্ধ রাখা ও রাস্তায় গাড়ি বার না-করার জন্য যথাক্রমে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন করেছেন কৃষকেরা। কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেড়া বলেন, ভারত বন্ধের দিনে দেশের সব দলীয় কার্যালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবেন কংগ্রেস কর্মীরা।