বলজিৎ কৌর । নিজস্ব চিত্র
‘আয়নায় নিজেকে দেখুন। প্রতিযোগিতাটা ওর সঙ্গেই।’
হোয়াটসঅ্যাপ স্টেটাস এ কথা লিখে রেখেছেন যে তরুণী, ভারতীয় পর্বতারোহণের মানচিত্রে গত এক মাসে উল্কার গতিতে উত্থান তাঁর। মাত্র ৩০ দিনে এভারেস্ট-সহ নেপালের পাঁচটি আটহাজারি শৃঙ্গ ছুঁয়ে প্রথম ভারতীয় হিসাবে রেকর্ড গড়েছেন। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে সবচেয়ে বেশি আটহাজারি শৃঙ্গজয়ের (মোট ৬টি) কৃতিত্বও তাঁর পকেটে। হিমাচলের সোলান জেলার ছোট্ট পঞ্জোরা গ্রামের মেয়ে, বছর সাতাশের বলজিৎ কৌর অবশ্য বলছেন, ‘‘পাহাড়কে বুঝতে আর ভালবাসতে চেয়েই পরপর শৃঙ্গ চড়েছি, নিজের ক্ষমতা যাচাই করতে চেয়েছি। রেকর্ডের কথা মাথায় ছিল না।’’
২০২২-এর পর্বতারোহণ মরসুমকে অনেকেই বলছেন ‘মহিলা আরোহীদের বছর’। ভারতের পিয়ালি বসাক, প্রিয়াঙ্কা মোহিতে, বলজিৎ থেকে নরওয়ের ক্রিস্টিন হ্যারিলা, আমেরিকার আড্রিয়ানা ব্রাউনলি— নেপালের একের পর এক আটহাজারি পথে দাপিয়ে বেরিয়েছেন এই কন্যারা। তাই এই মরসুম পর্বতারোহণ নিয়ে মেয়েদের গতানুগতিক মানসিকতাকে পাল্টে দেবে বলেই আশাবাদী বলজিৎ। ‘‘পর্বতারোহণ নিয়ে অনেকেই ভাবেন, ওটা মেয়েদের জন্য নয়। কারণ মেয়েদের শারীরিক গঠন আলাদা। তাঁদের বলব, পিরিয়ড আমাদের শক্তি, দুর্বলতা নয়। পিরিয়ড আর পেটে-কোমরে প্রবল ক্র্যাম্পের কষ্ট সয়েই কিন্তু মাকালু সামিট করেছি। গত বছর পুমোরি অভিযানে অনেকে বলেছিলেন, এই শৃঙ্গ মেয়েদের জন্য নয়। তাঁদের জবাব দিইনি, কাজে করে দেখিয়েছি’’— অকপট ওই তরুণী।
হিমাচলের ছোট্ট গ্রাম থেকে এক মাসে পঞ্চশৃঙ্গে অসাধ্য সাধন — এই পথটাও মোটেই মসৃণ ছিল না। বলজিৎকে সোলানের সরকারি কলেজে ভর্তি করাতে মঙ্গলসূত্র বেচেছিলেন মা। পেশায় বাসচালক বাবা সে কথা আজও জানেন না। কলেজে পড়াশোনা চালানোর জন্য বলজিৎ সোলানে যে বাড়িতে থাকতে গিয়েছিলেন, সেখানে ভাড়া দেওয়ার সামর্থ ছিল না তাঁর। তাই ভাড়া দেওয়ার বদলে তাঁদের রান্নাবান্না, গৃহস্থালির কাজ করে দিয়ে তবে কলেজে যেতেন বলজিৎ। পরে যোগাসন-জিম প্রশিক্ষক, ট্রেকিং দলনেতা— কী করেননি! কলেজে পড়াকালীন এনসিসি-র হাত ধরেই পাহাড়-প্রেমের হাতেখড়ি। ২০১৬ সালে যান প্রথম এভারেস্ট অভিযানে। সেখানে অক্সিজেন মাস্ক খারাপ হয়ে যাওয়ায় কাঁদতে কাঁদতে ফিরতে হয় তাঁকে। বলছেন, ‘‘তখন খুব রাগ হয়েছিল। এখন মনে হয়, ভালই হয়েছিল। জীবনে ব্যর্থতারও প্রয়োজন আছে, তাতে ভিতরের শক্তি কতটা তা চেনা যায়।’’
এর পরে গত ছ’বছর ছোট-বড় শৃঙ্গে গিয়ে শুধুই নিজেকে প্রস্তুত করার পালা। আট মাস বাড়ি ছেড়ে ট্রেনিং আর স্পনসরের খোঁজে পড়ে থেকেছেন গুরগাঁওয়ে। গত বছর ধৌলাগিরি (৮১৬৭ মিটার) সািট করার পরে এ বার মিংমা শেরপার সঙ্গে আরও পাঁচটি আটহাজারি জয় করে পিছনে ফেলেছেন মহারাষ্ট্রের প্রিয়ঙ্কাকে। পাহাড়ে গিয়ে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হননি, অথচ পরিজনদের থেকে শুনতে হয়েছে— ‘মেয়ে তো, পাহাড়ে গিয়ে কী হবে! তার চেয়ে চাকরির চেষ্টা করো। ভাল ছেলে দেখে বিয়ে করে নাও।’ কী বলতেন? ‘‘তখন উত্তর দিইনি, কারণ সে সময়টা আমার ছিল না। এখন তাঁরা বুঝেছেন, আমি নাম-খ্যাতি, পয়সা বা রেকর্ডের জন্য পাহাড়ে যাই না। পাহাড় চড়া আমার কাছে পুজো করার সমান।’’— বলছেন তরুণী।
পর্বতারোহী নির্মল পূরজার মতো একই মরসুমে একাধিক শৃঙ্গে অভিযান এখনও ভারতীয় পর্বতারোহী মহলে সে ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তাই হিমাচলের একটি উঠতি মেয়ে একসঙ্গে তিন-তিনটে শৃঙ্গ (অন্নপূর্ণা, এভারেস্ট-লোৎসে) অভিযান করবেন— তা অনেকেই ভাবতে পারেননি। তাই অভিযানের জন্য তেমন স্পনসরও জোটেনি। পরে বলজিতের তালিকায় ক্রমশ জুড়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা-মাকালুর নাম, সাফল্য দেখে এগিয়ে এসেছে স্পনসরেরা। তবে পিয়ালির মতো বলজিতেরও চিন্তা এই অভিযানের বিপুল খরচ। বলছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত মাত্র দু’টি শৃঙ্গ অভিযানের টাকা জমা করতে পেরেছি, বাকি ৪০ লক্ষ টাকা। তার জন্য স্পনসর আর সরকারি সাহায্যের অপেক্ষায় আছি। না-হলে পিয়ালির মতোই ক্রাউড ফান্ডিং করতে হবে।’’
তবে শুধু রেকর্ড নয়, সঙ্গে করে বহু অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে নেপাল থেকে ফিরছেন বলজিৎ। অন্নপূর্ণা সামিট করে ফেরার পথে তুষারঝড়ে পথ হারিয়েছিলেন, সঙ্গীকে বাঁচাতে নিজের অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়েছিলেন। কাঞ্চনজঙ্ঘায় দেখে ফেলেছিলেন পুণের মৃত পর্বতারোহী নারায়ণ আইয়ারের দেহ নীচে নামানোর দৃশ্য— যা বদলে দিয়েছে তাঁর জীবন-দর্শন।
আপাতত এ বছরে নেপাল-চিনের বাকি আটহাজারি শৃঙ্গগুলিতে অভিযান পরবর্তী টার্গেট এই কন্যার। চিনের আটহাজারি শৃঙ্গগুলিতে অভিযান করতে ক্রিস্টিনের সঙ্গে হয়তো আবেদন করবেন তিনিও। সেটা কী রেকর্ডের খাতিরেই? ‘‘রেকর্ড তো ভাঙার জন্যই। আমায় দেখে কোনও ছেলে বা মেয়ে নিজের সবটুকু দেওয়ার চেষ্টা করলে তিনিই হয়তো এক মরসুমে আরও বেশি শৃঙ্গ ছুঁতে পারবেন। আমিও পারি, এটা শুধু মন থেকে বিশ্বাস করতে হবে।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।