গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
শুরুরও যেমন একটা শুরু থাকে, প্রাথমিকের আগে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা যেন ঠিক তেমনটাই। দেশের একটা বড় অংশে প্রথম শ্রেণির আগে থেকেই বাচ্চাদের ‘পড়াশোনা’র সূচনা হয়ে যাচ্ছে। এ রাজ্যও তার বাইরে নয়। প্রাথমিক স্কুলের আগেই সারি দিয়ে রয়েছে, প্রি-প্রাইমারি, নার্সারি, মন্তেসরি, কিন্ডারগার্টেন— আরও কত কী! কিন্তু শিক্ষা শুরুর এই শুরুটাই বন্ধ করে দিচ্ছে হরিয়ানা সরকার। সম্প্রতি তারা ঘোষণা করেছে, প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ! অর্থাত্ বন্ধ করে দেওয়া হবে সমস্ত বেসরকারি নার্সারি বা কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুল।
হরিয়ানায় প্রায় সাড়ে আট হাজার বেসরকারি স্কুলে এখন নার্সারি বা কেজি সেকশন চালু রয়েছে। কিন্তু কবে থেকে বন্ধ হবে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান? রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী কানোয়ার পাল যদিও সামনের শিক্ষাবর্ষ থেকেই পদক্ষেপ শুরুর কথা জানিয়েছেন, তবু তাঁর শিক্ষা দফতরেই এখনও এ নিয়ে প্রভূত বিভ্রান্তি রয়েছে।
শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, কী কারণে এই সব স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে হরিয়ানায়? যুক্তি খুব স্পষ্ট। সরকারের মতে, প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আসলে শিশুদের শৈশব চুরি হয়ে যাচ্ছে। ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে শিশুদের। ঠিক করা হয়েছে, বাচ্চারা ভর্তি হবে সরাসরি প্রথম শ্রেণিতে। তবে, খেলাধুলোর মাধ্যমে কিছু শেখার জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বা প্লে স্কুল রাখা যেতে পারে।
এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকেই। কোনও কোনও মহলে আবার তা তুমুল সমালোচনার মুখেও পড়েছে। এ রাজ্যেও শিক্ষাবিদ-রাজনীতিকরা মোটামুটি দু’ভাগ।
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার কার্যত সমর্থনই করেছেন হরিয়ানা সরকারের সিদ্ধান্তকে। তবে তিনি কিছু শর্তও দিচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ছোটদের সাধারণ ভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া উচিত। ছোট থেকেই লেখাপড়ার চাপের মধ্যে না দিয়ে স্বাধীন ভাবে বিকশিত হওয়ার একটা সময় দরকার হয়। যে সময়টা তারা লেখাপড়ার কথা ভাববেই না। তবে সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এমন বন্দোবস্ত করতে হবে যাতে, প্রাথমিক স্কুলগুলিতেই খেলাধুলো এবং লেখাপড়ার মধ্যে সমন্বয় সাধন হতে পারে।’’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সময়ে তো পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগে হাতেখড়িই দেওয়া হত না। কিন্তু এখনকার অভিভাবকদের মত যেন, মায়ের পেটে থেকেই শিক্ষাগ্রহণ শুরু করুক শিশুরা। আমি মনে করি, আগেকার শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কোনও ভুল ছিল না।’’
আরও পড়ুন: বিজেপিকে ভোট দেওয়ার খেসারত নাগরিকত্ব বিল, মোদী সরকারকে আক্রমণ চিদম্বরমের
কিন্তু হরিয়ানার এই সিদ্ধান্তকে কার্যত কাণ্ডজ্ঞানহীন বলেই মনে করছেন রাজ্যের স্কুল সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অভীক মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট-২০০৯ না মেনে হরিয়ানা সরকার কী ভাবে এটা করল! জানি না, কোন শিক্ষাবিদের মাথায় এটা এসেছে! পৃথিবীর সমস্ত শিক্ষাবিদ প্রি-প্রাইমারি এবং নার্সারি শিক্ষার কথা বলছেন। অথচ এরা!’’
রোহতকের শিক্ষা দফতরের আধিকারিক বিজয়লক্ষ্মী নান্দাল বলেছেন, খেলাধুলো এবং মানসিক বিকাশের জন্য শিশুদের পর্যাপ্ত সময় পাওয়া দরকার। বর্তমান চালু প্রথায় শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বিঘ্নিত হচ্ছে। কিন্তু অভীকের মতে, ‘‘এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। প্রি-প্রাইমারি, নার্সারি বা মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্যই হল একটা বিশেষ পথে শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটানো। যাঁরা চালু করেছেন, আমার মনে হয় তাঁরা আগে এই শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করে নিন।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুরা স্কুলে এসে খেলাধুলো, গান, ছবি আঁকা এ সবের মধ্যে দিয়ে অ্যাকটিভিটি বেসড লার্নিং সিস্টেমে শিখছে। এটা একেবারে শিশুদের আনন্দময় শিক্ষা। যাঁরা শিক্ষাবিজ্ঞান মানেন না, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে মানতে চান না তাঁরাই হরিয়ানা সরকারের এই ব্যবস্থার পক্ষে মত দিতে পারেন।’’
আরও পড়ুন: নির্ভয়া দোষীদের ফাঁসি শীঘ্রই! তিহাড় জেলে এল ফাঁসির দড়ি, ‘ডামি’ দিয়ে মহড়াও সারা
রাজ্যের সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য মনে করেন, এতে আসল উদ্দেশ্য সাধিত হবে না, বরং গিমিক হবে। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের দেশে ক্লাস ওয়ানের নীচে কোনও সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা নেই। অভিভাবকরা প্রাইভেট শিক্ষা ব্যবস্থায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ ক্লাস ওয়ান থেকে যে শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, তাতে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। নিজেদের সন্তানকে সেই প্রতিযোগিতার উপযুক্ত করে তোলার জন্য সেটা স্বাভাবিক। সেই কারণেই তাঁরা এই ব্যয়বহুল শিক্ষাব্যবস্থার পথে হাঁটছেন।’’
অভিভাবকরা কী ভাবছেন? চুঁচুড়ার পারমিতা চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘ছোট শিশুদের মুক্ত ভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া উচিত। স্কুলে যদি সেই পরিবেশ থাকে এবং খোলামেলা পরিবেশে খেলাধুলোর মাধ্যমে ওরা শিখতে থাকে, তা হলে তো খারাপ নয়। কিন্তু অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ এবং স্কুলের জন্য যাতে অধিকাংশ সময় ফুরিয়ে না যায়, সেটাও মাথায় রাখা দরকার। বেসরকারি স্কুলের রমরমা, লাগামছাড়া ফি নেওয়া আটকাতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বন্ধ করার উদ্যোগ ভাল। তবে একই সঙ্গে সরকারি স্কুলগুলির পরিকাঠামো আরও ভাল ও পর্যাপ্ত না করলে আসল লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে না।’’
পারমিতার বক্তব্যের সূত্র ধরে তন্ময়বাবুও বলছেন, ‘‘আগে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় সব শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করার মতো পরিকাঠামো তৈরি করে তার পরে প্রি-প্রাইমারি বন্ধ করা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। তার আগে এটা করা অভিভাবকদের আরও বেশি সমস্যায় ফেলার সমিল। এতে আসল উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। শিক্ষাও প্রসারিত হবে না।’’ সেই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘শিশুদের শৈশব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বলে যেটা বলা হচ্ছে, সেটা অংশত সত্য। শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়ছে। আগে সরকার এটা সুনিশ্চিত করুক যে, কোনও শিশুই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না এবং এক কিলোমিটারের মধ্যে স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাবে, তাহলে এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে পারি।’’
‘পড়া পড়া খেলা’। একটি প্রি-প্রাইমারি স্কুলে। ছবি: সংগৃহীত।
প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা এবং বর্তমানে তৃণমূলে যোগ দেওয়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওমপ্রকাশ মিশ্র আবার এর মধ্যে যেন রাজনীতি খুঁজে পাচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘‘হরিয়ানায় বিজেপির সরকার রয়েছে। আবার কেন্দ্রেও বিজেপির সরকার। কিন্তু হরিয়ানা সরকারের এই সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের প্রস্তাবিত শিক্ষা নীতির বিরোধী। কোনও পর্যালোচনা না করে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া প্রাইমারি বা প্রি প্রাইমারি স্তরে বার বার নীতি পরিবর্তন করলে অস্থিরতা তৈরি হবে।’’
এ রাজ্যে যাঁরা বেসরকারি উদ্যোগে এমন স্কুল চালাচ্ছেন, তাঁরা কী বলছেন?
উত্তর ২৪ পরগনার একটি মফস্সল শহরে এমনই একটি প্রাক্-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক স্কুল চালান শান্তনু দে। তিনি বলেন, ‘‘এই সব স্কুলগুলির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়ানো দরকার। শিশুদের উপর যাতে অত্যধিক মানসিক চাপ না পড়ে, অতিরিক্ত ফি না নেওয়া হয়, শিক্ষাকে যেন ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিণত না করা হয়, তার জন্যই সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। তবে বেসরকারি প্রাক্প্রাথমিক স্কুল এ ভাবে বন্ধ করে দিলে আখেরে শিক্ষা ব্যবস্থারই ক্ষতি হবে।’’
পাঠদান: একটি প্রি-প্রাইমারি স্কুলে শারীরবিদ্যার ক্লাস। ছবি: সংগৃহীত।
এ বিষয়ে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং শিক্ষাসচিব মণীশ জৈনের সঙ্গে বার বার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।