প্রতীকী ছবি।
ভারতে নতুন বছরের প্রথম সূর্য উঠেছে আশার আলোয় আকাশ রাঙিয়ে। সেই আশা অবশ্যই রোগমুক্তির। কোভিডের শৃঙ্খল ভেঙে পুরনো জীবনে ফিরে যাওয়ারও। যেখানে মাস্ক ছাড়া খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার হাতছানি আছে। রয়েছে বহু দিন পরে বন্ধুদের গা ঘেঁষে বসে আড্ডা আর হুল্লোড়ের হাতছানিও।
একের পর এক প্রতিষেধকের ছাড়পত্র পাওয়ার খবরেই যে বিশ্ব এমন নতুন ভরসায় বুক বাঁধছে, তাতে সন্দেহ নেই। ব্রিটেন, আমেরিকা, ইজ়রায়েল-সহ কিছু দেশে তা দেওয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভারতের মতো ১৩৫ কোটি মানুষের দেশে এই টিকা ঘিরে যে আশঙ্কার ধুকপুকুনিও রয়েছে, তা বেশ টের পাচ্ছি কয়েক হাজার মাইল দূরে আমেরিকার মাটিতে বসেও। অনেকের মনেই প্রশ্ন, এত তাড়াহুড়ো করে বাজারে আনা টিকা সত্যিই গুণমানে ভাল তো? তা নেওয়ার পরে যে শরীরে তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
কোনও টিকা কিংবা ওষুধের দরুন কারও শরীরে কোনও রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে না, এমন কথা বহু-বহু বছরের গবেষণার পরেও হলফ করে বলা শক্ত। সেখানে এই টিকা তো বাজারে আসছে গবেষণা শুরুর এক বছরের মধ্যে! তাই আশঙ্কা স্বাভাবিক।
কিন্তু আমার পরামর্শ, ভরসা রাখুন। সাবধানতায় বিন্দুমাত্র ঢিলেমি না-দিয়ে। পেশাগত ভাবে রোগী সুরক্ষার বিষয়টি নিয়েই আমার রোজকার নাড়াচাড়া। অক্সফোর্ডের টিকাকে সুরক্ষিত করতে গত এক বছর দিন-রাত এক করে কাজ করেছি আমরা। তাই মনে হল, সেই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলে হয়তো অযথা আতঙ্ক কমবে। তেমনই কোন কোন বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে, দু’কথা বলে নেওয়া যাবে সেই প্রসঙ্গেও।
প্রথমেই বলি, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা, ফাইজ়ার-বায়োএনটেক, মর্ডানার যে সমস্ত টিকা বাজারে আসছে, তিন দফায় কিন্তু তার পরীক্ষা হয়েছে হাজার-হাজার স্বেচ্ছাসেবীর উপরে। স্ত্রী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। দেখা হয়েছে, সুস্থ এবং অসুস্থের উপরে তার প্রভাব কী। ফলে কম সময়ে টিকা আনা হলেও, পরীক্ষায় ঘাটতি রাখা হয়নি।
টিকার বিষয়ে জেনে রাখুন
ভরসা কোথায়?
• যে সমস্ত প্রতিষেধক বাজারে আসছে, তিন দফায় পরীক্ষা হয়েছে বিভিন্ন দেশের নানা বয়স ও জাতির স্বেচ্ছাসেবীর উপরে। যার মধ্যে স্ত্রী, পুরুষ উভয়েই ছিলেন।
• সুস্থ মানুষকে যেমন পরীক্ষামূলক টিকা দেওয়া হয়েছে, তেমনই তা প্রয়োগ করা হয়েছে সুগার, প্রেশারের মতো হাজারো অসুখ থাকা লোকের উপরে।
• খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে, কারও কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না। ত্রুটি ধরা পড়লে, তার ক্রমাগত সংশোধন হয়েছে।
সংশয় কিসের?
• সাধারণত প্রতিষেধক বাজারে আসতে গড় সময় লাগে ১০ বছর। সেখানে এই টিকা আসছে কার্যত এক বছরেরও কম সময়ে।
• এত অল্প সময়ে তৈরি টিকা নিয়ে শেষমেশ ক্ষতি হবে না তো?
• দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিক্রিয়া হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
সাবধানে পা
আগেই জানুন
• যে প্রতিষেধক নিচ্ছেন, তার কোনও স্বাভাবিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কি না। থাকলে, তা কত দিনের মধ্যে দেখা দেয়?
• সরকারি নির্দেশিকা, এমনকি টিকার লিফলেটেও তা লেখা থাকবে। অযথা দুশ্চিন্তা এড়াতে এটি জরুরি।
আগেই বলুন
• আগে কোনও টিকা নিয়ে কষ্ট বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়েছে কি না।
• কোনও টিকা, ওষুধ বা খাবারে অ্যালার্জি আছে কি?
• কোনও অসুখ আছে কি না (সুগার, প্রেশার, হার্ট অথবা কিডনির অসুখ ইত্যাদি)।
• প্রতিষেধক নেওয়ার আগের এক মাসের মধ্যে গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়েছিলেন কি? হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল?
• কোভিড পজ়িটিভ হয়েছিলেন কি? সেরে গিয়ে থাকলে, জানান তা-ও।
• নিয়মিত কী কী ওষুধ খেতে হয়?
• পারিবারিক ভাবে কোনও অসুখ কিংবা অ্যালার্জি কোনও ওষুধ বা টিকায় আছে কি না।
• অন্তঃসত্ত্বা? হলে, কত সপ্তাহের?
• এখন স্তন্যপান করাচ্ছেন কি না।
প্রতিক্রিয়া হলে
• ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন।
• সেই সঙ্গে জানান:—
• নিজের নাম, জন্মতারিখ, বয়স।
• প্রতিষেধকের নাম।
• নির্মাতা সংস্থার নাম।
• টিকার ব্যাচ, এক্সপায়ারি ডেট, কত নম্বর ডোজ়।
• টিকা নেওয়ার দিন, সময়।
• কী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, মৃত্যু কিংবা পক্ষাঘাতের মতো কিছু ঘটেছে কি না, আর প্রতিক্রিয়া কাটিয়ে উঠে থাকলে, এখন কেমন আছেন।
• সঙ্গে অবশ্যই আপনাকে যোগাযোগের ঠিকানা, ফোন নম্বর।
জানাবেন কাকে?
• যাঁরা টিকা দেওয়ার দায়িত্বে।
• সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিক।
• টিকা নির্মাতা সংস্থা।
প্রতিষেধক পরীক্ষার সময়ে স্বেচ্ছাসেবীদের এক দলকে সত্যিই টিকা দেওয়া হয়। অন্য দলকে প্লেসবো। সহজ করে বললে, হয়তো টিকার জায়গায় মামুলি গ্লুকোজ় জল। কিন্তু কেউ জানতে পারেন না যে, তিনি কী পাচ্ছেন। পরে এঁদের সবার তথ্য বিশ্লেষণ করে এক লপ্তে অনেক জনের মধ্যে বড় মাপের কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কিন্তু আমাদের কখনও চোখে পড়েনি। তবু পরীক্ষা চলাকালীন যেখানেই সামান্যতম ত্রুটি চোখে পড়েছে, যেখানে অভিযোগ মিলেছে সামান্যতম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার, সেখানে সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা হয়েছে তা দূর করার। তাই অধিকাংশ মানুষকে কোনও সমস্যার মুখে পড়তে হবে না বলেই আমরা আশাবাদী।
কিন্তু ও-ই যে বলে, সাবধানের মার নেই। তাই প্রতিষেধকের সাত-পাঁচ জেনে তবে তা নেওয়ার পথে পা বাড়ান (বিস্তারিত সঙ্গের সারণিতে)।
যেমন, প্রত্যেক টিকার নিজস্ব কিছু সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। কোনওটিতে হয়তো হাল্কা জ্বর আসে। নিলে মাংসপেশিতে সামান্য ব্যথা হয় কোনওটিতে। শিশুদের দেওয়া কিছু বহুল প্রচলিত টিকাতেই তো এমনটা হয়, তাই না? সুতরাং, কোভিডের টিকা নেওয়ার আগে পড়ে দেখুন, তার তেমন কোনও সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে কি না। তা হলে অযথা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি। কিন্তু তার বাইরে যদি কোনও তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন, তবে অবশ্যই অবিলম্বে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। প্রতিষেধক নির্মাতা, টিকা দেওয়ার দায়িত্বে থাকা টিমকে জানান আপনার সমস্যার কথা। মনে রাখবেন, আপনার নিজের তো বটেই, বাকিদের জন্যও কিন্তু এই তথ্য জরুরি। তা ছাড়া মনে রাখবেন, নিজের ও পরিবারের অসুস্থতার ইতিহাস, ওষুধ-টিকায় অ্যালার্জি ইত্যাদি বিষয়েও আগাম জানিয়ে রাখা জরুরি।
এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, আমেরিকা-সহ পশ্চিমী দুনিয়ার তুলনায় ভারতে টিকার নিরাপত্তার উপরে নজরদারি বেশ খানিকটা ঢিলেঢালা। তাই আপনার তরফ থেকে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। মনে রাখবেন, টিকা নিয়ে কারও শরীরে কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখার টিমে থাকবেন ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, জেলা ও রাজ্য স্তরের টিকাকরণ অফিসার, সম্ভবত টিকা বিপণন সংস্থার প্রতিনিধিও। তাই কোনও রকম অসুবিধার মুখে পড়লে, এঁদের জানান। কী ভাবে, কোথায় সহজে তা করা যাবে, সেই বিষয়টি নিশ্চয় আগামী দিনে আরও স্পষ্ট করে দেবে সরকারি নির্দেশিকা।
আমার অনুরোধ, সংবাদমাধ্যম বা অন্যেরা কী বলল, তার ভিত্তিতে কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা জানাবেন না। সেটিই বলুন, যেটি আপনি নিজে উপলব্ধি করেছেন। নইলে চিকিৎসা ও তথ্য দু’ই ভুল হবে।
তথ্য জমা দিলেও, আপনার নাম-ঠিকানা গোপন থাকবে। তাই প্রতিক্রিয়া হলে, তা জানান দ্রুত। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না-করে। কে বলতে পারে, আপনার ভাগ করে নেওয়া অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আপনার ছেলে-মেয়ের টিকা আরও নিরাপদ হবে না?
আর হ্যাঁ, টিকা আসছে বলে আপাতত মুখোশে মুখ ঢেকে দূরত্ব-বিধি মেনেই চলতে ভুলবেন না।
(মতামত ব্যক্তিগত)