ফাইল চিত্র।
২৯ জানুয়ারি লোকসভায়, আগামী আর্থিক বছরের জন্য (২০১৮-’১৯) বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে। যদিও বাজেট অধিবেশন সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হওয়াই রেওয়াজ। কিম্তু এ বছর কেন্দ্রীয় সরকার এগিয়ে এসেছে।
১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সাধারণ বাজেট লোকসভায় পেশ করবেন। উল্লেখ্য, এ বছরের বাজেটই হবে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের শেষ বাজেট। কারণ ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচন। ফলে বাজেট করা যাবে না। পেশ করতে হবে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ‘ভোট অন অ্যাকাউন্ট’।
গত বাজেটে, প্রথম রেল বাজেটকে পৃথক ভাবে পেশ না করে, সাধারণ বাজেটের অঙ্গীভূত করে প্রথম পেশ করা হয়। এ বছরেও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না।
রেল পৃথক বাজেটের কৌলীন্য হারালেও, এ বছর অনেকেই, বিশেষত রেল-বিশেষজ্ঞরা তাকিয়ে আছেন, রেলে কোন খাতে কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়, তার দিকে। বিশেষ করে গত অগস্ট মাসের শেষে কয়েক দিনের মধ্যে উপর্যুপরি কয়েকটি রেল দুর্ঘটনায় বেশ কয়েক জনের প্রাণহানি ঘটায় রেল সুরক্ষার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে সেই বিষয়ে সকলে আগ্রহী।
এ কথা সকলেরই জানা, সামগ্রিক ভাবে রেল বিগত বেশ কিছু বছর ধরে আর্থিক দৈন্যদশার মধ্য দিয়ে চলছে। বছর ঘুরছে। নতুন করে বাজেট এসেছে। কিন্তু অবস্থার উন্নতি তো ঘটেইনি, অভিজ্ঞতা বলেছে, আর্থিক অনটন বেড়েছে। তার কারণ ‘রাজনীতি’। রেল বাজেট হয়েছে, রেলের দিকে তাকিয়ে নয়। রেলমন্ত্রীরা ভোটের বাক্সের দিকে তাকিয়েছেন। রেলের স্বাস্থ্যোদ্ধারের পরিবর্তে, বাজেটে শুধু জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য নতুন ট্রেন চালিয়ে চমক দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। দীর্ঘকাল এক পয়সাও রেলের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। ফলে প্রাক্তন এক রেলমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, ‘রেল আইসিইউ’-তে ঢুকে গিয়েছে। রেললাইন মেরামত প্রায় উপেক্ষিত ছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এই মুহূর্তে প্রাপ্ত হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫-’১৬ সালে রেলে ফাটলের সংখ্যা ৩২৩৭ থেকে ২০১৬-’১৭ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৪৬-এ। মান্ধাতা আমলের ইঞ্জিন বা কামরা দিয়ে ট্রেন চালানোর ফলে, ২০১৬-’১৭ সালে, সাড়ে চার হাজার ডিজেল বা বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনের বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। চলন্ত দূরপাল্লার ট্রেনের ৮১০টি কামরা ট্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে যাওয়া বা সিগন্যাল বিগড়ে যাওয়ার ঘটনাও তথৈবচ। ২০১৫-’১৬ সালে ওভারহেড তার ছিঁড়েছিল ৩৭৮টি ক্ষেত্রে। ২০১৬-’১৭ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪৭-এ। ২০১৬-’১৭ সালে ১,৩০,২০০টি সিগন্যাল বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।
বলা বাহুল্য, এগুলির প্রত্যেকটির জন্যই কিন্তু বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। দ্রুত গতিতে ছোটা ট্রেনের সামনে যদি ওভারহেড তার ছেঁড়ার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ হঠাৎ করে ব্যাহত হয় বা সিগন্যাল খারাপ থাকায়, যে সিগনাল হওয়ার কথা, তার পরিবর্তে ড্রাইভার আচমকা ঠিক উল্টো সিগন্যাল দেখেন, তখন হয় তাঁর বিচক্ষণতা অথবা দৈববলে উদ্ধার পেতে হয়।
আরও পড়ুন: ভোটের কিস্তিমাতে বাজেটের চার ঘুঁটি
যদিও রেলের পক্ষ থেকে সম্প্রতি দাবি করা হয়েছে, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ২০১৬-’১৭ এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসের তুলনায়, এ বছরে অর্থাৎ ২০১৭-’১৮ সালের ওই একই সময়ের অবস্থা অনেকটাই ভাল।
২০১৬-’১৭ সালের প্রথম আট মাসে যেখানে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ৭৭টি ঘটনা ঘটেছিল, চলতি আর্থিক বছরের ওই সময়ে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে ৩৭টি।
২০১৫-’১৬ সালে নভেম্বর পর্যন্ত অন্য কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল ১০৭টি এবং ২০১৬-’১৭ সালের ওই ক’মাসে ঘটেছিল ১০৪টি। কিন্তু বর্তমান আর্থিক বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত দুর্ঘটনা হয়েছে ৪৯টি।
প্রহরীবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার দরুন এ বছর মৃত্যু ঘটে এক জনের। দু’টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা এ যাবত্ ঘটেছে তিনটি। গত বছর এই সময়ে পাঁচটি ঘটনা ঘটেছিল।
উল্লেখ্য, রেল দুর্ঘটনায় গত দু’বছরে প্রাণহানি ঘটেছে ২৮৬ জনের এবং আহত হয়েছেন ৭৯৫ জন। এর মধ্যে এ বছরের অগস্ট মাসের উত্কল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনাতেই মারা যান ২৩ জন এবং আহত হন ১৫৬ জন।
রেলের যেটা সর্বাগ্রে প্রয়োজন সেটা হচ্ছে রেললাইন মেরামতের কাজ। অর্থাভাবে লাইনগুলি দীর্ঘকাল সংস্কার না করার ফলে এগুলির বর্তমান অবস্থা যথেষ্ট দুর্বল। এর উপর দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে, ফলে আশঙ্কার কারণ থেকেই যায়।
সম্প্রতি রেলমন্ত্রক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা কয়েক বছরের মধ্যে মোট সাড়ে ১৬ হাজার কিলোমিটার ‘ডবল’ লাইন বা ‘ট্রিপল’ লাইন বসাবার ব্যবস্থা করবেন। যেখানে স্বাধীনতার ৭০ বছর পরে মাত্র ২২ হাজার কিলোমিটার রেললাইনের প্রবর্তন করা গিয়েছে।
গত বাজেটে মোট সাড়ে পাঁচশো কোটি টাকা ধার্য হয়েছিল রেলের জন্য। তার মধ্যে ২১২ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল লাইন পাতার কাজে। রেল লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছিল তিন হাজার ৬০০ কিলোমিটার রেল নির্মাণের। চলতি আর্থিক বছরের নভেম্বর পর্যন্ত লাইন পাতা হয়েছে প্রায় দু’হাজার কিলোমিটার। অর্থাত্, এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার লাইন পাতার কাজ এখনও বাকি।
আগেই বলা হয়েছে, এ বছরের অগস্টের শেষের দিকে পরপর চারটি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছিল। ধরা পড়েছিল লাইনে ফাটলের কথা।
সম্প্রতি রেলমন্ত্রক কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে বলে অনেকে মনে করছেন। রেল দফতর থেকে বলা হয়েছে, প্রতি দিন সাড়ে ন’কিলোমিটার রেল লাইনের কাজ করা হবে। এ যাবত্কাল হচ্ছিল দৈনিক পাঁচ কিলোমিটার।
আমেরিকার অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ২০১৮ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ৩৬০০ কিলোমিটার লাইন মেরামতির কাজ সম্পূর্ণ করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি আর্থিক বছরের শেষে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার লাইন নির্মাণের কাজও সম্পন্ন করা হবে বলে রেলের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে অগস্ট মাসের উপর্যুপরি চার চারটি দুর্ঘটনার ফলস্বরূপ পীযূষ গয়ালের রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে রেলমন্ত্রক যেন কিছুটা সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষত রেলমন্ত্রী কড়া ভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, অন্য সব বিষয় ব্যতিরেকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে ট্রেন চলাচলের ‘নিরাপত্তা’কে। বলা হয়েছে, লাইন সংস্কারের কাজকে প্রাধান্য দেবার কারণে বর্তমানে কিছু দিন ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা যদি মার খায়, তাতেও কোনও ক্ষতি নেই।
এরই জের হিসেবে আমরা দেখেছি সম্প্রতি খড়্গপুরের রুট রিলে ইন্টারলিঙ্ক কেবিন-কে আধুনিক করার জন্য প্রায় তিন দিন ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। এর জন্য অসংখ্য ট্রেন বাতিল করতেও রেল পিছপা হয়নি।
স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়াকে (সেল) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে উত্কৃষ্ট মানের রেললাইন সরবরাহ করার জন্য। ‘সেল’ও সে কাজে হাত দিয়েছে বলে জানিয়েছে। প্রয়োজন মোতাবেক সম্পূর্ণ পরিমাণ উত্কৃষ্ট মানের লাইন উত্পাদন যেহেতু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, রাতারাতি সম্ভব নয়, রেল তাই ‘গ্লোবাল টেন্ডার’ ডেকেছে।
রেলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গত বাজেটে এক লক্ষ কোটি টাকার ‘রেল সুরক্ষা কোষ’ গঠন করার কথা ঘোষিত হয়েছিল।
রেল প্রশাসন দৈনিক সারা দেশে ৭১৭২টি স্টেশন ছুঁয়ে ১২৬১৭টি যাত্রিবাহী ট্রেন ৬৪,৪৬০ কিলোমিটার পাড়ি দেবার জন্য সমগ্র রেল পরিষেবাকে কতটা সুরক্ষিত করতে পেরেছেন এবং আগামী বছরে কী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তা জানতে সকলকে অপেক্ষা করতে হবে।