National News

ত্রিপুরা: শেষ অঙ্কের পর্দা ওঠার আগে শেষ মুহূর্তের অঙ্ক কষা চলছে

কিন্তু এ বার কী এমন ঘটল যাতে গোটা দেশের আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে গেল উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ্য? যে রাজ্য থেকে লোকসভা আসন সংখ্যা মাত্র দুই, সেখানে কেনই বা এই বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে এত হইচই?

Advertisement

তাপস সিংহ

আগরতলা শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৫:০৩
Share:

এ বার বিজেপির লাগাতার প্রচার কৌশল বহু জায়গাতেই প্রভাব ফেলবে বলে সিপিএমের দলীয় নেতা-কর্মীদের একাংশের অভিমত।

সিপিএমের দলীয় দফতরে বসে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দাসকে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী বলেই মনে হল। ‘‘দেখুন, আমরা তো শুধু ভোট এলে কাজ করি, এমন নয়। আমরা সারা বছরই মানুষের পাশে থেকে কাজ করি। ফলে বিজেপির এই প্রচারে আমাদের আলাদা করে চিন্তিত হওয়ার কারণ ঘটেনি।’’

Advertisement

হয়তো ঘটেনি। তা ছাড়া, ফাইনাল ম্যাচের আগে কোন ক্যাপ্টেনই বা বলেন যে বিরোধী দলকে নিয়ে তাঁরা চিন্তিত? এটা ঘটনা যে, ১৯৮৮-র পর থেকে এ পর্যন্ত এ রকম চ্যালেঞ্জের মুখ সিপিএম এর আগে পড়েনি। ’৮৮-তে সিপিএম এ রাজ্যে হেরেছিল কংগ্রেস-টিইউজেএস জোটের কাছে। ’৯৩ সালে তারা আবার ক্ষমতায় ফেরে। তার পর থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর সিপিএমকে আর পিছনে ফিরতে হয়নি।

কিন্তু এ বার কী এমন ঘটল যাতে গোটা দেশের আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে গেল উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ্য? যে রাজ্য থেকে লোকসভা আসন সংখ্যা মাত্র দুই, সেখানে কেনই বা এই বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে এত হইচই?

Advertisement

বস্তুত, এই হইচই বেধেছে বিজেপির চূড়ান্ত তৎপরতা থেকে। আইপিএফটি-র সঙ্গে জোট বেঁধে বিজেপি এ বার জনজাতীয় ভাবাবেগকে মূলধন করেছে। এর পিছনে অবশ্যই উপজাতীয় এলাকার বাম দুর্গের মূলে কুঠারাঘাত করতে চায় তারা। তফসিলি জাতি ও উপজাতি মিলিয়ে ত্রিপুরায় বিধানসভার সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৩০। উপজাতীয় এলাকায় উন্নয়নের কাজ করার জন্য সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী (সিক্সথ সিডিউল) তৈরি হয়েছে স্বশাসিত জেলা পরিষদ। উপজাতীয়দের অন্যতম প্রধান ভাষা ককবরক-কে রাজ্য ভাষার স্বীকৃতিও দিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার। এ ছাড়া অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মসূচিও নিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার।

আরও পড়ুন: ভোট কাটার অঙ্ক কি চিন্তায় ফেলেছে মোদীকে?

তা সত্ত্বেও এ বার বিজেপির লাগাতার প্রচার কৌশল বহু জায়গাতেই প্রভাব ফেলবে বলে সিপিএমের দলীয় নেতা-কর্মীদের একাংশের অভিমত। উপজাতীয়দের জন্য আলাদা রাজ্যের দাবিকে সমর্থন না করলেও তাদের পাশে টানতে নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বিজেপি। নির্বাচনী জোট সহযোগী আইপিএফটি-কে পাশে নিয়ে সিপিএমের ওই ভিতে আঘাত হানতে চায় তারা। প্রত্যেককে স্মার্টফোন দেওয়া, প্রতি ঘর থেকে একটা করে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভোটারদের একটা অংশকে প্রভাবিত করবে বলে সিপিএমের আশঙ্কা। যদিও প্রচারে নেমে সিপিএম নেতৃত্ব বলছেন, ‘‘ওদের স্মার্টফোন হল ‘ওয়ান টাইম ইউজ’-এর জন্য। এক বার ব্যবহার করলেই ফেলে দিতে হবে।’’

আরও পড়ুন: সিপিএমের কায়দাতেই ত্রিপুরার বুথে বুথে ঘুঁটি সাজাচ্ছে বিজেপি

সিপিএমের কপালে ভাঁজ ফেলছে নতুন ভোটার এবং যুব সম্প্রদায়। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী এ বারেই প্রথম ভোটাধিকার পেয়েছেন এমন ভোটারের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৮০৩। তাঁদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ২৬ হাজার ৫৪ এবং মহিলার সংখ্যা ২১ হাজার ৭৪৫। এবং তৃতীয় লিঙ্গের সংখ্যা চার। এ ছাড়া ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত ভোটারের সংখ্যাও কম নয়। এই নতুন ভোটারদের বেশ বড় অংশের ‘দোদুল্যমানতা’ সিপিএমকে ভাবাচ্ছে। যে কারণে, একেবারে শেষ মুহূর্তের প্রচার পর্বে বুথ ধরে ধরে এই ধরনের ভোটারদের ও তাঁদের বাড়ির লোকজনকে বোঝাচ্ছেন সিপিএম কর্মীরা। সকাল সকাল নতুন ভোটারদের নিয়ে বুথে যেতে পরামর্শ দিচ্ছেন সিপিএম কর্মীরা।

বুথ স্তরে স্থানীয় মানুষকে বলা হচ্ছে, ‘বহিরাগত’ দেখলেই প্রশাসনকে খবর দিন। এই ‘বহিরাগত’ বলতে সিপিএম যাঁ‌দের বোঝাতে চাইছে, তাঁরা হলেন বিজেপির পাঠানো ‘বিস্তারক’ ও স্বেচ্ছাসেবকেরা।

আগরতলা শহরাঞ্চলের ভোটারেরা বরাবরই সিপিএম-বিরোধী। যেমন, ২০১৩-র বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী সুদীপ রায় বর্মণ (এখন বিজেপিতে) আগরতলা কেন্দ্রে জিতেছিলেন। টাউন বড়দোয়ালিতে জেতেন কংগ্রেসের আশিস কুমার সাহা (তিনিও বিজেপিত)। শহরাঞ্চল বাদ দিলে ত্রিপুরার গ্রামাঞ্চল সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি। অন্তত ২০১৩ পর্যন্ত তা-ই ছিল। কিন্তু যে বিজেপি ২০১৩-য় কোত্থাও ছিল না, সেই বিজেপি-ই এ বার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে, অনুন্নয়নের প্রশ্নে বিঁধছে তাদের।

‘অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি’ বা ক্ষমতা বিরোধিতাও কপালে লম্বা ভাঁজ ফেলেছে সিপিএমের। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাও মাখায় রাখছেন সিপিএম নেতৃত্ব। দীর্ঘ ২৫ বছর এ রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার পরে জনগণের প্রত্যাশার পারদও চড়ছে। সেখান থেকেই লড়াইটা ধরেছে বিজেপি তাদের ‘চলো পাল্টাই’ স্লোগানের মাধ্যমে। সিপিএমের একটা ভরসার জায়গা অবশ্য কংগ্রেসও। কারণ, কংগ্রেস যত বিজেপির ভোট কাটবে, তত লাভবান হবে সিপিএম। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পর্যন্ত এখানে প্রচারে এস বলছেন, কংগ্রেস ‘ভোট কাটুয়া’ পার্টি।

সিপিএম সরকারের একটা বড শিরঃপীড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি চলে যাওয়া ১০ হাজার ৩২৩ জন শিক্ষকের। বিজেপির অভিযোগ, সিপিএম সরকারের অকর্মণ্যতার জন্যই এই শিক্ষকদের এ হেন হেনস্থা হতে হচ্ছে। ফলে যুযুধান দুই শিবিরই এই শিক্ষকদের ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়ে চিন্তিত এবং তাঁদের ‘পাশে থাকা’র প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে দু’দলই।

বামফ্রন্টের একটা মস্ত বড় অস্ত্র মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। জনতার দরবারে মুখ্যমন্ত্রীর এই ভাবমূর্তিকে তুলে ধরছেন তাঁরা। পাশাপাশি বলছেন, কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারের গত চার বছরের ‘হতাশাজনক’ ভূমিকার কথাও। বলছেন, যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছিল সে সব প্রতিশ্রুতিই তারা রাখতে পারেনি। আর ত্রিপুরায় তারা যা যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তা রাখবে কী করে?

তবে সিপিএম রাজ্য নেতৃত্ব মনে করেন, প্রচারে যে ঝড়ই তুলুক না কেন বিজেপি, মাটির কাছাকাছি নেমে কাজ করেছে একমাত্র সিপিএম। কোনও কোনও কেন্দ্রে ভোটের ব্যবধানে সামান্য হেরফের হলেও শেষমেশ বিজয়ীর হাসি হাসবে মানিক সরকারের দলই।

শুক্রবার বিকেলে প্রচার শেষ। রবিবার ভোট। এর পর ফলের জন্য অপেক্ষা আরও কয়েক দিনের। টানটান উত্তেজনার এই কাহিনির শেষ অঙ্কের পর্দা ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করেই দেখা যাক!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement