ওয়াশিংটনে একটি বৈঠকে নির্মলা সীতারামন। রবিবার। পিটিআই
সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত আট বছরে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ইডি-র মামলার সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে। তার মধ্যে ৯৫ শতাংশ মামলাই বিরোধী দলের রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফ্যামের মতো আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চেও ইডি-আয়কর দফতর হানা দিয়েছে। মোদী সরকারের সমালোচনা বা নীতির ভুল ধরলেই নাগরিক সংগঠন থেকে গবেষণা সংস্থাকে কোপের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ।
আজ ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাঙ্কের বৈঠক সেরে ফেরার আগে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে এ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হল। কারণ ইডি ও আয়কর দফতর, দুই-ই তাঁর অর্থ মন্ত্রকের অধীনে। এবং অর্থমন্ত্রী মুখের একটিও রেখা না কুঁচকে উত্তর দিলেন, ‘‘ইডি পুরোপুরি তাদের কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীন।’’ অর্থমন্ত্রীর যুক্তি, ইডি নিজে থেকে কোনও অপরাধের তদন্তে নামে না। প্রথমে সিবিআই বা অন্য কোনও সংস্থা তদন্ত শুরু করে। তার সূত্র ধরে আর্থিক নয়ছয়ের দিকটি খতিয়ে দেখতে ইডি মাঠে নামে।
আজই সিবিআই দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়াকে মদের দোকানের লাইসেন্স বন্টনের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার ডেকে পাঠিয়েছে। ইডি এই মামলায় দিল্লিতে তল্লাশি চালিয়েছে। বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, মোদী জমানায় শুধু ইডি-র মামলা, তল্লাশির সংখ্যা বাড়েনি। ইডি-র হাতে বিপুল ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীকে জিজ্ঞাসাবাদ, ন্যাশনাল হেরাল্ড দফতরে তল্লাশি চালাচ্ছে ইডি। আম আদমি পার্টি, এসপি, আরজেডি, শিবসেনা, এনসিপি, ন্যাশনাল কনফারেন্স-সব সব বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধেই ইডি সক্রিয়। বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা দেশের গবেষণা সংস্থাগুলিতেই ইডি, আয়কর দফতরের তল্লাশি চালিয়ে হেনস্থা করা হচ্ছে। বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে এই সংস্থাগুলির বিদেশি অনুদানের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সেই কারণেই বিদেশের মাটিতে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে।
আজ অর্থমন্ত্রী সীতারামন বলেন, ‘‘আমি নির্দিষ্ট মামলা নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। ইডি যদি কোথাও তল্লাশি চালাতে যায়, তা হলে প্রাথমিক ভাবে হাতে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই যায়। কিছু তল্লাশির খবর সংবাদমাধ্যমেও উঠে এসেছে। যেখানে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, সোনা, গয়না আটক করা হয়েছে। ইডি-কে পদক্ষেপ করতে হয়েছে।’’ বিজেপি নেতারা মনে করছেন, মুখে না বললেও অর্থমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর বাড়িতে উদ্ধার হওয়া টাকা, গয়নার উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, ইডি-র পদক্ষেপে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ তোলা ভুল।
কংগ্রেসের বক্তব্য, যেখানে প্রমাণ রয়েছে, সেখানে অবশ্যই তদন্ত, তল্লাশি হোক। তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু বিজেপিতে যোগ দিলেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডি-র তদন্ত হিমঘরে চলে যাচ্ছে কেন? কংগ্রেস নেতা তথা ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বঘেল বলেন, ‘‘বিরোধী শাসিত রাজ্যে শাসক দলের বিরুদ্ধে ইডি, আয়কর দফতর হানা দিচ্ছে। অথচ ছত্তীসগঢ়েই বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির অভিযোগ থাকলেও ইডি কিছুই করছে না।’’
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোদী জমানায় আট বছরে ইডি-র তল্লাশির সংখ্যা ইউপিএ জমানার ১০ বছরের তুলনায় ২৭ গুণ বেশি। রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ইডি-র মামলার সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে। তার মধ্যে ৯৫ শতাংশ মামলাই বিরোধী দলের রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, মোদী জমানায় আট বছরে ইডি-র মামলা, তল্লাশির সংখ্যা বাড়লেও অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করার হার মাত্র ০.৫ শতাংশ। যার ফলে স্পষ্ট, ইডি-র কাজ শুধুমাত্র বিরোধীদের হেনস্থা করা। সনিয়া-রাহুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরেও রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের ইডি ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় সমন পাঠাচ্ছে। রাহুলোর ভারত জোড়ো যাত্রা কর্নাটকে ঢুকতেই রাজ্যের প্রদেশ সভাপতি ডি কে শিবকুমারকে ইডি সমন পাঠিয়েছে। ইডি-কে রাজনৈতিক ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে।
তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র সুখেন্দুশেখর রায় বলেন, ‘‘আমেরিকার বিখ্যাত জার্নালে সে দেশের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন ছেপেছে। বলা হয়েছে, ভারতে অপছন্দের শিল্পগোষ্ঠী ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে সরকার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে লেলিয়ে দেয়। এই সমস্ত কিছুর পেছনে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, সলিসিটর জেনারেল, তদন্তকারী সংস্থাগুলির বিভিন্ন পদাধিকারী ও সর্বোচ্চ আদালতের জনৈক বিচারপতির যোগসাজশ রয়েছে বলে সুস্পষ্ট অভিযোগ করা হয়েছে।’’ সুখেন্দুর দাবি, অর্থমন্ত্রী ওয়াশিংটন সফরে তা যথারীতি অস্বীকার করেছেন। কিন্তু আমেরিকার মতো দেশে এমন অভিযোগ ওঠার কোনও পূর্ব নজির নেই। এ দেশে বিরোধীরা যে অভিযোগ করে চলেছে, তা অন্তত আমেরিকায় মান্যতা পেয়েছে। এ বার মার্কিন জার্নালে যে বিশেষ তথ্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে তার উচ্চ পর্যায়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করা হোক। শিবসেনার নেত্রী মনীষা কায়ন্দে বলেন, ‘‘অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন, সেটা রসিকতা। উনি বিদেশের মাটিতে বসে দেশের মানুষকে ভুল পথে চালিত করছেন।’’