(বাঁ দিকে) পিনারাই বিজয়ন। সীতারাম ইয়েচুরি (ডান দিকে)। —গ্রাফিক সনৎ সিংহ।
তিন বছরের মধ্যে ১০ শতাংশ ভোট কমেছে কেরল সিপিএমের। তা নিয়ে উদ্বেগের কথা প্রকাশ্যেই জানিয়েছে একে গোপালন ভবন। কিন্তু সিপিএমের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, দলের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ কাজ করছে কেরলে একের পর এক মামলায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডির ‘সক্রিয়তা’ নিয়ে।
সম্প্রতি ত্রিশূরের একটি সমবায় ব্যাঙ্কের তহবিল তছরুপের মামলায় সিপিএমের প্রায় ৭৩ লক্ষ টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি। তার আগে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের মেয়ে বীণা বিজয়নের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, তারও তদন্ত করছে ইডি। ওই মামলায় নাম জড়িয়েছে বিজয়নেরও। এ রকম আরও কতগুলি মামলায় ইডি ধরপাকড়ও শুরু করেছে কেরলে। তাতে সিপিএমের যোগ রয়েছে বলে অভিযোগ। ইডির এই সক্রিয়তাই উদ্বেগ তৈরি করেছে সিপিএমের মধ্যে।
ঘরোয়া আলোচনায় সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলেছেন, ‘‘কেরলে ইডি অক্টোপাসের মতো ধরছে। যে মডেলে গোটাটা শুরু হয়েছে, তা খুব একটা শুভ সঙ্কেত নয়।’’ তবে প্রকাশ্যে ইডির ভূমিকাকে রাজনৈতিক ‘প্রতিহিংসা’ হিসাবেই দেখাতে চেয়েছে সিপিএম। দলের পলিটব্যুরোর সদস্য নীলোৎপল বসু বলেন, ‘‘ইডি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা রাজনৈতিক ভাবেই তাকে প্রতিরোধ করব।’’
কেরলের রীতি ভেঙে ২০২১ সালের ভোটে জিতে পর পর দু’বার সরকার গঠন করেছে সিপিএম। তার পর বিবিধ ঘটনায় পিনারাই বিজয়নের সরকারকে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যে ভাবে বামেদের ভোট কমেছে কেরলে, এবং একই সঙ্গে বিজেপি মাথা তুলেছে, তা নিয়ে গভীর আত্মসমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন সিপিএমের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পাশাপাশি কেরল সিপিএমের একাংশের নেতাদের আর্থিক ভাবে অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও দলকে বিড়ম্বিত করছে।
পিনারাই-কন্যা বীণার বিরুদ্ধে ইডি যে তদন্ত করছে, সেই বিষয়টি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে বিবৃতি দিয়েছে সিপিএম। কিন্তু তা যে রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল, তা-ও মানছেন অনেকে। তবে কেরলে ইডির সক্রিয়তা বাংলায় প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হওয়া সিপিএমকেও অন্য ভাবে ভাবাচ্ছে। রাজ্য সিপিএমের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, ‘‘কেরলে যদি আমাদের বড় কাউকে গ্রেফতার করে, তা হলে আমরা এখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কথাই বলতে পারব না। সে ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক পরিসর আরও সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। আমরা যদি কেরলের ক্ষেত্রে বলতে যাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, তা হলে লোকে আরও হাসাহাসি করবে।’’ আবার এ-ও বাস্তব, সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসও ইডিকে ‘বিজেপির রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হিসাবে মনে করলেও কেরলে বামেদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হলে তারাও রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে চেষ্টা করবে। কারণ, সেই রাজ্যে বামেদের মূল প্রতিপক্ষ কংগ্রেসই।
বাংলার এক সিপিএম নেতার কথায়, ‘‘এখনও আমাদের রাজ্যে আমাদের দলের নেতারা যে সাধারণ জীবনযাপন করেন, তা কেরলে নেই। ওখানকার নেতাদের বৈভব রয়েছে। ওখানে বড় ব্যবসায়ী আমাদের দলের নেতা। এটা ওখানকার বাস্তবচিত্র। সেটা একটা দিক। কিন্তু দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হওয়া ভিন্ন বিষয়। যা সামগ্রিক ভাবে পার্টির ভাবমূর্তিতে ধাক্কা দিতে পারে।’’
১৯৭৭ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত এই ৪৭ বছরে কখনও দেশে এমন হয়নি যে, একটি রাজ্যেও বামেদের ক্ষমতা নেই। সিপিএমের আশঙ্কা, ২০২৬ সালে সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি দলকে দাঁড়াতে হতে পারে। এই ৪৭ বছরের মধ্যে ৩৪ বছর বাংলায় টানা ক্ষমতায় ছিল সিপিএম। ত্রিপুরাতেও ১৯৯৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত একটানা সরকার চালিয়েছে বামেরা। এর মধ্যে কেরলে সিপিএম ক্ষমতায় থেকে গিয়েছে, আবার ফিরেও এসেছে। কখনও কখনও বাংলা, ত্রিপুরা, কেরল— একসঙ্গে তিন রাজ্যে সরকার চালাত বামেরা। এখন শিবরাত্রির সলতের মতো জ্বলে রয়েছে কেরল। রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, বড় কোনও অঘটন না-ঘটলে ত্রিপুরা এবং বাংলায় সিপিএমের ফেরার আপাতত কোনও সুযোগ নেই। ২০২৬ সালে কেরলে সরকার বদল হলে দেশ কার্যত বামশূন্য (রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার নিরিখে) হয়ে যাবে। সেটিও দলকে ভাবাচ্ছে বলে মানছেন সিপিএম নেতাদের অনেকেই।