শনিবার দুপুরে পর পর দু’বার কলকাতা কেঁপে ওঠার পরে সোশ্যাল সাইটে বার্তা ছড়াল— ‘এটাই শেষ নয়। নাসা বলেছে পরের ভূমিকম্পটি আসছে বেলা তিনটে নাগাদ। সেটা আরও শক্তিশালী। দয়া করে কেউ সে সময় বাড়ির মধ্যে থাকবেন না।’
ফোনের জ্বালায় অস্থির আলিপুর আবহাওয়া দফতর। এ ভাবে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া যে সম্ভব নয়, সেই বার্তা দেওয়া হল হাওয়া অফিস থেকে। কিন্তু কোথায় কী, কলকাতা ও শহরতলির অনেক লোকই বেলা আড়াইটেয় ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন ভূমিকম্প থেকে বাঁচতে। বেলা তিনটেয় অবশ্য কিছুই হল না।
কিন্তু সোশ্যাল সাইটের ‘জেঠুদের’ থামাবে কে? সতর্কবার্তা ভেসে এল— সময় বদলেছে প্রবল ভূমিকম্পের। রাত তিনটেয় তা আসছে!
সেটাও হল না। কিন্তু বেহালার এক চিকিৎসক দম্পতি ঘরে আলো জ্বেলে রাখলেন শনিবার সারা রাত। জেগে থাকলেন তাঁদের অনেক বন্ধুবান্ধবও। তবে রাত জাগাটাই সার। ভূমিকম্পের দেখা নাই!
আর শিলিগুড়ি?
ঘরবাড়ি প্রায় ফাঁকা। গোটা শহর যেন রাস্তায় নেমে এসেছে। বড় রাস্তা, অলিগলি, লেন-বাই লেনের ধারে দাঁড়িয়ে বাসিন্দারা। অশীতিপরদের চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির পোষ্য কুকুর, পাখির খাঁচাও তিনতলা থেকে নামিয়ে এনে রাখা হয়েছে রাস্তার ধারে। পাড়ার পার্কে মাদুর বিছিয়ে সার বেঁধে বসে রয়েছেন বাসিন্দারা। শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে খোলা আকাশের নীচেই। সকলেরই চোখে মুখে আতঙ্ক। উৎকণ্ঠাও। ঘুরেফিরে দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শিলিগুড়ির প্রতিটি পাড়ায়, রাস্তাঘাটে একটাই গুজব, ‘‘আবার হবে ভয়ানক ভূমিকম্প!’’
গুজবের ঢেউ উঠেছে গ্যাংটক থেকে পেলিং— সিকিম জুড়েও। বারে বারে আরও বড় ভূকম্পের ‘খবরে’ মানুষ জন বেরিয়ে এসেছেন বাড়ি ও হোটেলের বাইরে। আতঙ্কের জেরে বাজারও আকাশ ছুঁয়েছে। তবে সেই ভয়ানক ভূকম্প কিন্তু আসেনি!
কিন্তু ‘জেঠুরা’ এত তাড়াতাড়ি রণে ভঙ্গ দেবেন কেন?
বিজ্ঞানী, শিক্ষক, কর্পোরেট কর্তাদের মোবাইলে আসতে লাগল নতুন বার্তা। তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে নাসার নাম নেওয়া হল এ বারেও। বলা হল— ‘নাসা বলেছে আগামী এক সপ্তাহ ধরে বড় মাপের ভূমিকম্প হয়েই যাবে। কারণ, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে ইউরেশীয় প্লেটের নীচে।’
গুজবে নাসার নাম থাকায় বিভ্রান্ত অনেকেই। ফের ফোন আলিপুর হাওয়া অফিসে। এ বার আবহবিদেরা ফটাফট খুলে ফেললেন নাসা-র সাইট। কোথায় কী, ভূমিকম্প নিয়ে নাসা-র কোনও পূর্বাভাসই নেই।
নাসার সাইট খুলে মানুষ যখন অনেকটাই নিশ্চিম্ত, তখন মোবাইলে ভেসে এল আরও একটি বার্তা— ‘ভূমিকম্পের জেরে কসমিক রে ঢুকে পড়বে পরিমণ্ডলে। ওই কসমিক রশ্মি থেকে বাঁচতে রাত সাড়ে ১২টায় সবাই মোবাইল বন্ধ করে রাখুন।’
মোবাইল বা সোশ্যাল সাইট নতুন নয়। কিন্তু ভূমিকম্পের মতো গুরুতর বিষয় নিয়ে অবৈজ্ঞানিক তথ্য প্রচার করে রসিকতা করার মতো এমন ঘটনা আগে ঘটেনি।
কী বলছেন আবহবিদ এবং ভূকম্প বিশেষজ্ঞেরা?
তাঁরা বলছেন, ভূমিকম্পের পরে প্রাকৃতিক যা কিছু পরিবর্তন, তা হয় ভূমিস্তরে। জলবায়ুকে প্রভাবিত করতে পারে না অতি বড় মাপের ভূমিকম্পও। আর ভূকম্প কবে কোথায় হবে, তা আগে থেকে বলা যায় না। শুধু কোন কোন এলাকা ভূমিকম্পপ্রবণ, সেটা বলা যেতে পারে।
খড়্গপুর আইআইটি-র ভূ-পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শঙ্করকুমার নাথ বলেন, ‘‘কে বা কারা যে এমন গুজব রটাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। বিজ্ঞান এখনও এমন জায়গায় যায়নি যে আগে ভাগে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া যাবে!’’
কেন তাঁরা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারেন না? শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘কোথায় কোথায় ভবিষ্যতে কত মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে, সে ব্যাপারে আমরা আগাম সতর্কতা জারি করতে পারি। কিন্তু ভূমিকম্প এমন একটা জটিল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যার দিন ক্ষণ আগে থেকে মিলিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।’’
কিন্তু কোথায় কোথায় ভবিষ্যতে কত মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে, সেই আভাস ভূ-বিজ্ঞানীরা দেন কী ভাবে?
শঙ্করকুমার নাথ বলেন, ‘‘মাটির নীচে কোথায় কোথায় চ্যূতি, কোথায় খোঁচ রয়েছে, কোথায় কোথায় বেশি পরিমাণে শক্তি সঞ্চয় হবে, তা আমরা মাপতে পারি। তাই ভূকম্পপ্রবণ এলাকাগুলিকে আমরা চিহ্নিত করে পারি। কিন্তু সেই জমে থাকা শক্তির কবে বিচ্ছুরণ হবে, তা কেউ বলতে পারে না। তাই পূর্বাভাসও দেওয়া যায় না।’’ আইআইটি-র ওই ভূ-বিজ্ঞানী বলেন, ‘‘শনিবার ভূমিকম্পের পরে কোথাও কোথাও যে প্রবল বৃষ্টি হল, সেটাকে ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়া বলে প্রথম গুজব ছড়ানো শুরু হয়েছিল। কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ পৃথক পদ্ধতি। বৃষ্টির সঙ্গে ভূকম্পের কোনও সম্পর্কই নেই।’’