রাবণ শিল্পীদের এখন ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে!
কলকাতায় যেমন পুজো শুরুর অনেক আগে থেকে শুরু হয়ে যায় দুর্গাপ্রতিমার কাজ, তেমনই পশ্চিম দিল্লির তাতারপুরে শুরু হয়ে যায় রাবণ তৈরি।
দশেরা উৎসবে যে রাবণকে পোড়ানো হয়, এ সেই রাবণ। এই রাবণ শুধু দিল্লি নয়, রফতানি হয় বিদেশেও, পুজোর মতো দশেরাও বিদেশে পালিত হয়। আর তার জন্য রাবণ জোগান দেন তাতারপুরের রাবণশিল্পীরা।
তাতারপুর হল দেশের বৃহত্তম ‘রাবণ ইন্ডাস্ট্রি’। দশেরা আসার অনেক আগে থেকেই তৈরি হয় রাবণ। এখানকার কারিগরেরা বছরে গড়ে এক হাজার রাবণ তৈরি করেন। কুমোরটুলিতে যেমন এখন থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা বুকিং, এখানেও ঠিক তেমনই শুরু হয়ে গিয়েছে রাবণ বুকিং। যত আগে রাবণ বুক করা যাবে রাবণের দাম তত কম হবে। মানে আগে বুক করা রাবণ পাওয়া যাবে কিছু কম দামে। রাবণের দাম শুরু হয় ৫০ হাজার টাকা থেকে। চার থেকে পাঁচ লাখ টাকার রাবণও তৈরি হয় এখানে।
দিল্লির দশেরার রাবণের এক ক্রেতা চরণ সিংহের মতে, “এখানকার তৈরি রাবণ অন্য জায়গার থেকে ভাল, তবে দেরিতে অর্ডার দিলে দাম বেশি হয়ে যায়, তাই এখন থেকেই অর্ডার দিতে আসা।”
দীর্ঘ দিন রাবণ তৈরি করে তাতারপুর রাবণ তৈরির কুমোরটুলি হয়ে উঠেছে। রাবণ কারিগরদের জনক হলেন প্রয়াত হুতনলাল। এখানে তিনি ‘রাবণ বাবা’ নামে পরিচিত। তাতারপুরে পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে এসে রাবণ তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। রাবণ তৈরি করে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। রাবণ তৈরির পুরস্কারও দেওয়া হয়। যে সর্বাধিক রাবণ বানাতে পারে সে ‘রাবণওয়ালাবাবা-সেবক-সত্তর’-এর তরফ থেকে এই পুরস্কার পেয়ে থাকে।
দশেরা উৎসবের তিন মাস আগে থেকে রাবণ তৈরির কাজ শুরু হয়। এই কারিগরেরা মূলত উত্তরপ্রদেশের হিন্দু হলেও কিছু মুসলিম কারিগরও আছে। এখন শুধু দিল্লি নয়, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, হরিয়ানা প্রভৃতি জায়গার রাবণের অর্ডারও আসে। অনেক দিন আগে থেকেই রাবণের অর্ডার জমা হওয়া শুরু হয়। শেষের দিকে ব্ল্যাক হয় রাবণের। দেবীপক্ষ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লিতে শুরু হয় রামলীলা। সে সময় প্রতি দিন রামের মাহাত্ম্য প্রচার হয়। সামিয়ানা বেঁধে বা রেকর্ড বাজে রামলীলার। এক এক জায়গায় এক এক রকম ভাবে রামলীলা চলে এখানে। রামলীলার শেষ দিন বিজয়া দশমীর দিনে দশেরা উৎসব পালিত হয়। রাবণের সঙ্গে রাবণের ছেলে ইন্দ্রজিৎ ও ভাই কুম্ভকর্ণর পুতুলও পোড়ানো হয়। দশেরাতে রাবণ বধকে মূলত অশুভের উপর শুভের জয় হিসাবে দেখা হয়।
রাবণের উচ্চতা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, ১০ ফুটের রাবণের সঙ্গে ৫০ ফুটের রাবণও এখানে দেখা যাবে। রাবণের ভিতরে থাকে কাগজের পিণ্ড, ফুয়েল। আবার অনেক সময় রাবণের ভিতরে কম্পিউটার ওয়েস্টেজও দেওয়া হয়। আগে রাবণের গায়ে মাটির রং ব্যবহার করা হত, তবে এখন কালের নিয়মে বিভিন্ন কেমিক্যাল পেন্ট ব্যবহার করা হয়। ব্যস্ততার সময় বিশালাকার রাবণ তৈরি করতে কারিগরদের গোটা পরিবারই হাত লাগায়।
আরও পড়ুন: অবশেষে ‘গোরক্ষক’দের জুলুম নিয়ে নিন্দায় মুখর মোদী
রাবণ তৈরির মূল উপকরণ বাঁশ, কাগজ, শাড়ি, পেরেক, দড়ি। রাবণ তৈরির সমস্যার দিক হল রাবণকে রাউন্ড করা, কারণ অনেক সময়ই বাঁশ ভেঙে মুশকিল হয়। অনেক কারিগর আবার রাবণ তৈরির সময় দিনমজুরের কাজ করে। দিনের হিসেবে পয়সা নেয় কেউ, কেউ আবার মরসুম হিসাবে থোক টাকা নেয়।
এমনই এক কারিগর রামলাল বলেন, “বছরে এক বার রাবণ তৈরি করে সারা বছরের টাকা তুলে নেওয়া হয়। তবে বছরের অন্যান্য সময় অনেক কারিগর বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো মূর্তি বা মাটির জিনিস তৈরি করে। তবে রাবণ তৈরিই এখানকার কারিগরদের মূল কাজ।”
দিল্লিতে বহুকাল ধরেই পালিত হচ্ছে এই উৎসব। ঠিক কবে থেকে শুরু দশেরার, এই প্রশ্নের উত্তরে পুরান সংক্রান্ত বিষয়ের লেখক অমিত শ্রীবাস্তব বলেন, “দিল্লিতে ১৬ শতকে রামচরিত মানসের গল্প অনুসারে রামলীলার প্রচলন হয়। দশেরার বর্তমান রূপের সূচনা হয় ১৭ শতকে শাহজাহান দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করলে। সেই সময় যমুনার ধারে লালকেল্লার কাছে দশেরা জাঁকজমক করে পালিত হত।’’
দশেরা চিরকালই যেন রাজকীয় ক্ষমতা প্রকাশের একটি মাধ্যম। শাহজাহানের আমলে শুরু হওয়া উৎসব এখন দিল্লির অন্যতম প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর দশেরার পালনের উৎসাহ যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।