ঠকানোর টাকা ফিরিয়ে শাপমুক্তি চান দুর্যোধন

কপট পাশায় যাঁদের রাজত্ব আত্মসাৎ করে রাজা হয়েছিলেন, সেই পাণ্ডবদের সূচ্যগ্র ভূমিও দিতে চাননি মহাভারতের দুর্যোধন। পরিণামে ভারত-যুদ্ধ এবং পরাভূত দুর্যোধনের হ্রদে আত্মগোপন। কৃষ্ণের সাহায্যে পাণ্ডবেরা তাঁকে খুঁজে বার করার পরে তিনি তাঁদের প্রাপ্য ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এমন কোনও সাক্ষ্য দেয় না মহাভারত।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৮
Share:

বদ্রীনাথে ধৃত দুর্গেশ মহারাজ। (ডান দিকে) ২০০৩ সালে তোলা দুর্যোধন মিশ্রের ছবি।

কপট পাশায় যাঁদের রাজত্ব আত্মসাৎ করে রাজা হয়েছিলেন, সেই পাণ্ডবদের সূচ্যগ্র ভূমিও দিতে চাননি মহাভারতের দুর্যোধন। পরিণামে ভারত-যুদ্ধ এবং পরাভূত দুর্যোধনের হ্রদে আত্মগোপন। কৃষ্ণের সাহায্যে পাণ্ডবেরা তাঁকে খুঁজে বার করার পরে তিনি তাঁদের প্রাপ্য ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এমন কোনও সাক্ষ্য দেয় না মহাভারত।

Advertisement

এ যুগের দুর্যোধন মিশ্র ওরফে দুর্গেশ মহারাজ কলকাতায় জালিয়াতি করে বিস্তর টাকা হাতিয়ে লুকিয়ে ছিলেন উত্তরাখণ্ডের বদ্রীনাথে। সিবিআই তাঁকে খুঁজে বার করার পরে তিনি অবশ্য প্রতারণা করে পাওয়া টাকা ফিরিয়ে দিতে মরিয়া।

এ ক্ষেত্রে বাংলার বিভিন্ন অর্থ লগ্নি সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে মিল নব দুর্যোধনের। ধরা পড়ার পরে সারদা, আইকোর, এমপিএসের মতো বেসরকারি অর্থ লগ্নি সংস্থার কর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের সব টাকাই ফেরত দিতে চেয়েছেন।

Advertisement

গ্রাহকদের ঠকিয়ে, জাল কিসান বিকাশ পত্র দিয়ে যে-টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছিলেন, তা ফিরিয়ে দিতে চাইছেন দুর্গেশ মহারাজ অর্থাৎ ডাকঘর এজেন্ট দুর্যোধন মিশ্রও।

টাকা ফেরানোর পন্থা-পদ্ধতি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও লগ্নি সংস্থার কর্ণধারদের সঙ্গে বেজায় মিল জাল সাধুবাবার। আমানতকারীদের টাকা নিয়ে লগ্নি-কর্তারা যে-বিপুল সম্পত্তি করেছেন, তা বেচেই ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরাতে চান। দুর্যোধনও সিবিআই-কে বলেছেন, গ্রাহকদের সঙ্গে জালিয়াতি করে নেওয়া টাকায় কলকাতায় তিনটি জমি ও দু’টি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন তিনি। এবং সেগুলি বিক্রি করেই টাকা ফেরত দিতে চান।

এই বোধোদয় কেন?

আত্মগ্লানি আর অনুশোচনা তাঁকে নাকি কুরে কুরে খাচ্ছিল। সন্ন্যাস নিয়েও তাই তিনি শান্তিতে থাকতে পারছিলেন না, সিবিআইয়ের জেরার জবাবে জানিয়েছেন দুর্যোধন।

বদ্রীনাথ থেকে গ্রেফতার করে কলকাতা আনার পথে সিবিআই অফিসারদের কাছে নিজের পলায়নের ইতিবৃত্ত শুনিয়েছেন দুর্যোধন। কলকাতায় ডাকঘরের গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করার পরে তাঁর বাড়িতে হানা দিতে শুরু করেন ক্ষিপ্ত মানুষজন। তাই স্ত্রী, দুই ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে মহানগর ছাড়েন দুর্যোধন। সেটা ২০০৩ সাল। ১২ বছর পরে, গত ৩ জুলাই তাঁকে বদ্রীনাথ থেকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। সন্ন্যাসের আড়াল নিয়ে দুর্গেশ মহারাজ নাম ধারণ করে বদ্রীনাথে আশ্রম খুলে বসেছিলেন তিনি। দিন দুই আগে কলকাতায় নিয়ে এসে এখানকার আদালতে তোলা হয় তাঁকে। আপাতত তাঁর ঠিকানা প্রেসিডেন্সি জেল। তিনি সিবিআই-কে জানিয়েছেন, ২০ জুলাই আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে নেবেন। তবেই তাঁর ‘শাপমুক্তি’ হবে।

কী ভাবে ধরা পড়লেন দুর্যোধন?

তপসিয়া থানা-সহ কলকাতা পুলিশের খাতায় রয়েছে দুর্যোধনের নাম। তাঁকে খুঁজতে কলকাতা পুলিশের একটি দল মধুবনি জেলায় গিয়েছিল। ফিরে আসে খালি হাতে। দুর্যোধনের আদি বাড়ি মধুবনিতে। সেখানে তাঁর আত্মীয়স্বজন থাকেন। সিবিআইয়ের দলও কখনও মধুবনি, কখনও দিল্লি, কখনও নেপাল গিয়েছে। ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর খোঁজ মিলছিল না। গত মার্চে তাঁর পরিবারের খোঁজ মেলে যোধপুরে। সেখান থেকে সূত্র পেয়ে বদ্রীনাথে গিয়ে গ্রেফতার করা হয় দুর্গেশকে।

এক যুগ বছর ধরে দুর্যোধনের পালিয়ে বেড়ানোর ইতিবৃত্ত রোমাঞ্চে ঠাসা। জেরার মুখে দুর্গেশ বা দুর্যোধন জানান, লোক ঠকিয়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ করে মুকুন্দপুরে তিনটি জমি কেনেন তিনি। তিন সন্তানের কথা ভেবেই। দেড় কাঠা, আড়াই কাঠা এবং সাড়ে তিন কাঠা আয়তনের সেই জমি তিনটি এখনও তাঁর এবং স্ত্রী রঞ্জুর নামেই আছে। এ ছাড়াও পার্ক সার্কাস এলাকায় দু’টি ফ্ল্যাট কেনেন তিনি। কিন্তু সেগুলিতে কখনওই বসবাস করেননি। থাকতেন ধাপার কাছে। যে-সব গ্রাহকের সঙ্গে তিনি প্রতারণা করেছেন, তত দিনে তাঁদের অনেকেই বুঝে গিয়েছিলেন তাঁর কারসাজি। শুরু হয় বাড়িতে হামলা। দুর্যোধন জানান, তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রথমে দিল্লি, পরে যোধপুরে চলে যান তিনি। সঙ্গে নগদ টাকা সামান্যই ছিল। কারণ, যে-টাকা পেয়েছিলেন, তা সম্পত্তি কিনতে খরচ হয়ে যায়। বাকি টাকা অন্যদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে দিতে হয়েছিল। পালানোর আগে জমি বা ফ্ল্যাট বিক্রি করার সুযোগও পাননি।

যোধপুরে এক আত্মীয়ের কাছে কিছু দিন থাকার পরে তাই জীবিকার খোঁজে নামতে হয়। একটি রবার কারখানায় দেড় হাজার টাকার বেতনে কাজ নেন দুর্যোধন। বড় ছেলে ছাত্র পড়িয়ে, স্ত্রী সেলাই করে সাহায্য করতেন। সাধুসঙ্গের শুরু সেখানেই। এক সাধুর সঙ্গে চলে যান হরিয়ানায়। যোধপুরে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে লড়াই চালাতে থাকেন স্ত্রী মঞ্জু। সেলাই করে মেয়েকে ডাক্তারি এবং ছোট ছেলেকে এমবিএ পড়ান তিনি। সাহায্য করেন বড় ছেলে।

দুর্যোধন সন্ন্যাস নিতে চাইলেও তাঁর পূর্ব ইতিহাসের জন্য বাধা পড়ে। হরিয়ানা থেকে অন্য এক সাধুর সঙ্গে চলে যান হরিদ্বার। ব্রহ্মচর্যের শুরু সেখানেই। সেটা ২০০৭। ২০০৯-এ চলে যান বদ্রীনাথে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবারের সঙ্গে। বছর দেড়েক পরে আবার যোগাযোগ হয় স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে। জানতে পারেন, মেয়ে এখন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। ছোট ছেলে উচ্চ পদে চাকরি করেন বেসরকারি সংস্থায়।

সব ফিরে পেয়ে মোবাইল-ফেসবুকে মজে যান এ-যুগের দুর্যোধন। তাঁর বন্ধুদের তালিকায় সন্ন্যাসী ছাড়াও অনেক বিদেশি-বিদেশিনির খোঁজ পেয়েছে সিবিআই। তালিকায় রয়েছেন বড় ছেলেও।

প্রতারিতদের টাকা ফিরিয়ে কবে তিনি মহাকাব্যের দুর্যোধনকে টেক্কা দেন, সেটাই এখন দেখার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement