দিল্লির পুজো। —নিজস্ব চিত্র।
যমুনার শুকিয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ মরা ডাঙায় হঠাৎ এক দিন সকালে সাদা প্রলেপ পড়ে। নিশ্চয়ই এক দিনে ঘটে না ব্যাপারটা, কিন্তু যমুনা সেতুর উপর দিয়ে ভীমবেগে যাতায়াত করা লাখো মানুষের নজর এড়িয়েই থাকে দিগন্তবিস্তারী সেই কাশ ফুলের ম্যাজিক। তার পর এক সোনা আলোর সকালে যমুনা তীরে কাশজঙ্গলে বাজতে থাকে আগমনী বার্তা। না দেখে আর উপায় থাকে না তখন!
সেদিনই প্রথম পুজো আসে রাজধানীতে। এ ছাড়া আলাদা করে তো বোঝার উপায় নেই শহরটাকে দেখে যে, দুর্গা ঠাকুর আসছেন। দু’দশক আগে প্রথম যখন দিল্লিতে আসি তার কয়েক মাসের মধ্যেই ছিল পুজো। তখনই অন্তত একশোটি পুজো হত রাজধানীতে। কিন্তু গোটা শহরের হস্তীসদৃশ আয়তনের কাছে এই সংখ্যা কীই বা আর! ভরা সপ্তমীর সকালে কনট প্লেস অথবা লোধি গার্ডেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ান— অন্য দিনের থেকে আলাদা করতে পারবেন না, সে আপনার কল্পনায় যতই পাখা লাগান না কেন!
তা হলে উপায়? প্রবাসী বলে কি বাঙালি মাঞ্জা দেবে না অষ্টমীর রাতে? সেরা তসর, ইক্কত, বা জামদানিটি পরে অঞ্জলি দেবে না নবমী সকালে? অথবা নতুনের গন্ধে ভরা কুর্তা পরে অলস আড্ডায় রাজা-উজির মারবে না প্যান্ডেলে? তা কী হয়, তা কী হয়!
দিল্লির পুজো ‘পকেট’ ধর্মী। হঠাৎ করে পুজো পাড়া (পাড়া বলাটা আবেগজনিত, আসলে মণ্ডপ) সামনে চলে আসে। তার ভিতরে আপনি ঢুকে পড়লে বাতাসে ধুনোর গন্ধ। সামনে আরতির নাচ, পুষ্পাঞ্জলি। ভোগ প্রসাদের দীর্ঘ লাইন। আর বাইরে বেরিয়ে এলে হাইরাইজ়, এইট লেনে বিন্যস্ত যথারীতি অতি-ব্যস্ত শহর দিনগত পাপক্ষয়ে দৌড়চ্ছে।
কিন্তু কোথায় পাবেন পুজোগুলির হদিস? আদৌ শক্ত নয়, কিছু দিন এই শহরে বসবাস করলে, বঙ্গবাহিনীর সঙ্গে ক’দিন ওঠাবসা করলেই পুজো মানচিত্র আপনার কাছে স্পষ্ট। নৈবেদ্যর উপরে স্বাস্থ্যবান নাড়ুর মতো দিল্লির পুজোতে দু’টি বাড়তি মাত্রা রয়েছে। এক, পঞ্চমী রাতের আনন্দমেলা। দুই, পুজোর জলসা। প্রথমটি সম্পূর্ণ ভাবেই স্থানীয় প্রবাসীদের নিজস্ব সংযোগসেতু। দ্বিতীয়টি আগে ছিল মূলত কলকাতা-মুম্বই কাঁপানো গায়ক গায়িকাদের কর্পোরেট দাক্ষিণ্যে আমন্ত্রণ। পরে মুদ্রাস্ফীতি, নোট-বাতিল, অতিমারির কারণে ক্রমশ পুঁজিতে টান ধরায় বেড়েছে স্থানীয় প্রতিভার কদর। প্রাচীন সময়ে দিল্লিতে পুজো হলেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান হত মূলত বাংলা গানের। রাজধানীর বাঙালিও অপেক্ষা করত এই সময়টার জন্য। সারা বছর না শুনতে পাওয়া বহু গানই রাজধানীবাসী শুনতেন পুজোর সময়, পুজোর জন্য। প্রবাসের জগাখিচুড়ি সংস্কৃতির মধ্যে শুধুমাত্র বাংলা গানের জন্য এই অপেক্ষা কিন্তু এখনও কমবেশি আছে। শিল্পীরা (তা সে কলকাতারই হোক বা স্থানীয়) যে গান পরিবেশন করেন মণ্ডপে, তার অর্ধেকেরও বেশি আজও বাংলাই। কচি কণ্ঠে প্রাচীন সেই মধুমালতীর ডাকে জলসায় ভিড় জমান প্রবীণেরা।
অন্য দিকে আনন্দমেলা আসলে একটি শারদীয় মেলা। মহিলাদের দ্বারা চালিত এই খাই খাই উৎসবে আগে পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না। ১০ বছর পর্যন্ত বালকদের জন্য অবশ্য ছাড় ছিল। বাড়ির মহিলারা তখন ঘুগনি, আচার, মাছের বড়ার মতো নানা ঘরোয়া খাবার বাড়ি থেকে রান্না করে এনে বিক্রি করতেন পঞ্চমী রাতে। ক্রেতারাও মহিলা। মূলত একে অন্যের বানানো খাবার কিনে, শেষে একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করতেন। আর বিষয়টা যাতে মহিলাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তার জন্য লাল রঙের কাপড় বা পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হত মেলা প্রাঙ্গণ! তবে তা বেশি দিন নয়। ক্রমে পুরুষরাও প্রবেশ করলেন হেঁসেলে। কালক্রমে এই আনন্দে যোগ দিলেন অবাঙালি পুরুষ-নারীও। এখন তো আনন্দমেলার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে রন্ধন প্রতিযোগিতাও। কোনও কোনও পুজোয় বিশিষ্ট জনেরা রান্না চেখে বিজয়িনীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন। আনন্দমেলার আরও একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের কথাও চালু রয়েছে রাজধানীতে, যা প্রজন্মবাহিত। মোগল সম্রাট আকবরের স্ত্রী জোধাবাই নাকি প্রচলন করেছিলেন ঠিক এ রকমই এক মেলার। যেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। মহিলারা বাড়ি থেকে নানা রকম সুস্বাদু পদ রেঁধে এনে
কেনাবেচা করতেন।
দিল্লিতে প্রথম দিককার দুর্গাপুজো কাশ্মীরি গেটে শুরু হয়েছিল ১৯১০-এ। ১৯১১ সালে ইংরেজরা কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী স্থানান্তর করে দিল্লিতে। সেই ডামাডোলে পুজোয় ভাটা পড়লেও ১৯১২ সাল থেকে আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয় পুজো। কাশ্মীরি গেটের পাশাপাশি তিমারপুর যোগ দেয় এই উৎসবে। তবে অনেকের মতে, দিল্লিতে প্রথম দুর্গাপুজোটি হয়েছিল ৩০০ বছরেরও আগে। তৎকালীন মোগল দরবারে বাণিজ্যের কারণে এসেছিলেন কিছু বাঙালি বণিক। সালটা ১৭১৪। কাজের টানে বঙ্গভূমে আর ফিরে যাওয়া হয়নি তাঁদের। অগত্যা সম্রাটের দ্বারস্থ হয়ে দুর্গাপুজোর অনুমতি আদায় করেন তাঁরা। সেই পুজো ঠিক কোথায় হয়েছিল, তার প্রামাণ্য নথি অবশ্য পাওয়া যায় না আর।
দিল্লির পুজোয় পেট পুজোরও বিস্তীর্ণ অবকাশ। প্যান্ডেলে সকালে ঘুগনি আর ঝালমুড়ির নস্টালজিয়া পুইয়ে, দুপুরের খিচুড়ি বা পোলাওতে ভোগ সেরে সন্ধ্যায় অস্থায়ী ফুড-স্টলে ভিড় জমতে থাকে। নবরাত্রিতে উত্তর ভারতীয়েরা উপবাস বা ব্রত করেন। অনেক রেস্তোরাঁতেই আমিষ মেলে না। বাঙালির ভরসা তখন থাকে প্যান্ডেলের বিরিয়ানি আর মাটন কষায়। চিত্তরঞ্জন পার্কে বাসস্টপ দখল করে ছাউনির তলাতেই হয় কষা মাংস-পরোটার আয়োজন। এ ভাবেই উৎসব ফিরে ফিরে আসে শাহি দিল্লিতে পুজোর ক’টা দিন। ঘর হতে শুধু কয়েক পা ফেলে আপনাকে তা খুঁজে নিতে হবে কেবল।