বিসিএ-র পুজোর প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। নিজস্ব চিত্র
গঙ্গাপাড়ের কলকাতায় যখন মহালয়ার পর থেকেই ভিড় বাড়ছে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে, ঠিক সে সময়েই সাবরমতীর তিরে আমদাবাদের বাঙালিরা ঘড়ি ধরে হিসাব করছেন ষষ্ঠীর আর কত ঘণ্টা বাকি। মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত এই শহরে পুজো হয় অন্তত ১২টি। এই দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে বেশ পুরনো ‘বেঙ্গল কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন’। বয়স ৮৫ বছর। স্থানীয়েরা অবশ্য একে ‘বিসিএ’ বলেই ডাকেন। আমদাবাদে বোপলের কাছে যে কালী মন্দিরটি রয়েছে, সেই মন্দিরের মাঠেই বিসিএ-র পুজো হচ্ছে। স্থানীয়দের মতে, আমদাবাদের সবচেয়ে বড় পুজো এটি। জাঁকজমকও এখানেই সবচেয়ে বেশি।
এই পুজোর আকর্ষণ এতটাই যে, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর পদে যিনিই থাকুন, এক বার অন্তত দেবীর দর্শন করেন বলে দাবি প্রবাসী বাঙালি মণিকা সেনের। বিবাহসূত্রে গত ১৭ বছর আমদাবাদে রয়েছেন তিনি। মণিকা বলেন, ‘‘প্রথম-প্রথম খুব মন খারাপ করত। ২০০৪-’০৫ সালে এখানে বড় জোর তিনটে পুজো হত। তবে বাঙালিদের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে উৎসাহও। দুর্গাপুজোও এখন বেড়ে অন্তত ১২টা।’’
এ বার দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির আদলে পুজোর মণ্ডপ তৈরি করছে বিসিএ। ঠাকুর তৈরির জন্য আনা হয়েছে কলকাতার মৃৎশিল্পী। পুরোহিতও কলকাতারই।
বিসিএ-র সদস্য মণিকা বলেন, ‘‘এ বার আমাদের পুজোর বাজেট এক কোটির বেশি। স্থানীয় বাঙালিরা এই পুজোয় সাধ্যমতো চাঁদা দেন। তবে স্পনসরশিপের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের নানা জায়গা থেকে অনুদানও আসে।’’ এ বার পুজোর উদ্বোধন করবেন আমদাবাদের মেয়র কিরিটকুমার জে পারমার। থাকবেন রাজ্যের মুখ্যসচিব পঙ্কজ কুমারও। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
মণিকার কথায়, ‘‘এই পুজো শুধু উৎসব নয়। একে বরং মিলনোৎসব বলা চলে। এই কয়েক দিন বাড়িতে রান্না বন্ধ। সকলে মিলে খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা। পুজোর আর এক আকর্ষণ হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।’’ মণিকার সঙ্গে একমত আর এক প্রবাসী বাঙালি সোনালি মল্লিকও। তিনি বলেন, ‘‘বিসিএ-র পুজোর রাতগুলোয় সকলেই অনুষ্ঠান দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন। এক দিন স্থানীয় শিল্পীরা পারফর্ম করেন। বাকি দিনগুলোয় বাইরে থেকে জনপ্রিয় শিল্পীদের নিয়ে আসা হয়। এ বার এক দিন অনুষ্ঠান করবেন লগ্নজিতা চক্রবর্তী।’’ তবে শুধু সঙ্গীত অনুষ্ঠান নয়, পুজোর অন্যতম আকর্ষণ হল নানা ধরনের প্রতিযোগিতা। শারদ সম্মান নয়, এ হল বিসিএ-র মণ্ডপে আয়োজিত ধুন্ধুমার লড়াই। সোনালি বলেন, ‘‘পঞ্চমীতে অঙ্কন প্রতিযোগিতা দিয়ে সূচনা। ষষ্ঠীতে নাচ, সপ্তমীতে আলপনা ও গানের প্রতিযোগিতা। অষ্টমী-নবমীর সন্ধ্যায় ধুনুচির লড়াই। চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হয় নবমীর রাতে।’’ এখানকার আর এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল আনন্দমেলা। অধিকাংশ পুজোতেই এই প্রবণতা দেখা যায়। আনন্দমেলায় যাঁরা ইচ্ছুক, তাঁরা খাবারের স্টল দিতে পারেন। তবে উৎসাহীর সংখ্যা খুব বেশি হলে লটারি করা হয়। বাড়ি থেকে নানা ধরনের খাবার তৈরি করে এনে বিক্রি করেন স্থানীয়েরা। ষষ্ঠী থেকে অবশ্য বিভিন্ন পেশাদার সংস্থা স্টল দেয় পুজো সংলগ্ন মাঠে। বিসিএ-র মাঠে আমিষ-নিরামিষ নানা পদের পাশাপাশি রকমারি ভোগ্যপণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। শাড়ি, পাঞ্জাবি, গয়না, বইয়ের পাশাপাশি ঘরসজ্জার জিনিসও থাকে। এমনকি ফ্রিজ-টেলিভিশনও সাজানো থাকে কয়েকটি স্টলে।
শুধু বিসিএ নয়, এখানকার উল্লেখযোগ্য পুজোর মধ্যে রয়েছে মণিনগর, ওএনজিসি, চাঁদখেরা, শান্তিগ্রাম টাউনশিপের পুজো। এর মধ্যে মণিনগরের কাছে কাংকারিয়া লেকের কাছে যে পুজো হয়, সেখানে নিখরচায় ভোগ খাওয়ানো হয় বলে জানালেন স্বাগতা রায় গোস্বামী। মুর্শিদাবাদের কান্দিতে জেমো রাজবাড়ির মেয়ে স্বাগতা অবশ্য কলকাতার পুজোর জন্য মনখারাপ করেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের জেমোর বাড়িতে প্রতি বছর ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়। বিয়ের আগে প্রতি বছর সেখানেই থাকতাম। তাই কলকাতার পুজো দেখা হয়নি। এখানে আসার পরে দুর্গাপুজোয় মায়ের আরাধনা এবং তাকে ঘিরে আনন্দোৎসব তো থাকেই। বাড়তি প্রাপ্তি নবরাত্রি। এই সময়ে গুজরাতিরা গরবা পালন করেন। আমরাও ডান্ডিয়া নাচে অংশ নিই।’’
পুজোর দিনগুলোর জন্য ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা সেরে ফেলেছেন স্বাগতা। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতিবারের মতো এ বারও সকালটা কাটবে দুর্গাপুজোর মণ্ডপে। বিকেল থেকে বিভিন্ন প্যান্ডেলে ঘোরার পাশাপাশি গরবার অনুষ্ঠানে যাব।’’ আর ঘরে ফেরা? স্বাগতা বলেন, ‘‘শুধু রাতটুকুর জন্য ফিরব। এই সময়ে সহজে বাড়ি ফিরতে চায় না আমার ছোট্ট মেয়েও।’’