মালবিকা রাজ জোশী
বোর্ডের পরীক্ষার একটাও সার্টিফিকেট নেই ফাইলে। স্কুলে যাওয়া বলতে ওই ক্লাস সেভেন পর্যন্ত। তার পর? ইতি নয়, যেন সেই সবে শুরু।
মাঝখানে পেরিয়ে গিয়েছে চারটে বছর। সে দিনের সেই স্কুলছুট মেয়েটিই আজ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে বিএসসি পড়তে যাচ্ছে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি)। রীতিমতো স্কলারশিপ জুটিয়ে। নাম, মালবিকা রাজ জোশী। বয়স সতেরো। মুম্বই শহরতলির নেহাতই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সেই মেয়ে এরই মধ্যে পৌঁছে গিয়েছে মার্কিন মুলুকে। ডিগ্রি নেই বলে সুযোগ মেলেনি আইআইটি-তে। কিন্তু তাতে কী? এমআইটি-র ক্লাস যে এই শুরু হল বলে!
ঠিক যেন সিনেমার গল্প। কিন্তু কী ভাবে সম্ভব হল বাস্তবে? মালবিকার ঝুলিতে সম্বল বলতে, আন্তর্জাতিক স্তরের প্রোগ্রামিং অলিম্পিয়াডে তিনটে পদক। আর মা সুপ্রিয়াদেবীর জেদ। বছর চারেক আগেই যিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মেয়েকে বাড়িতে রেখেই পড়াবেন। যা ওর প্রাণে চায়। মালবিকা তখন দাদার পার্সি ইউথ অ্যাসেম্বলি স্কুলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। দিব্যি ভাল ফলও করছিল! তা হলে?
সুপ্রিয়াদেবী আদতে এই প্রথাগত শিক্ষার ধারণাটাকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। নম্বর নয়, মা হয়ে আস্থা রেখেছিলেন মেয়ের মেধায়। ইঞ্জিনিয়ার স্বামীকে সবটা বোঝাতে অবশ্য প্রথম দিকটা ভালই বেগ পেতে হয়েছিল। সুপ্রিয়াদেবী তখনও একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় চাকরি করতেন। মেয়ের স্কুল ছাড়িয়ে, নিজেও ছেড়ে দেন চাকরিটা। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। মেয়েটার দিকে নজর দিতে হবে যে!
ব্যস্, তার পর বাড়িতেই মা-মেয়েতে জোরদকমে শুরু হয়ে যায় ‘পড়া-পড়া খেলা’। সে সব দিনগুলোর কথা ভোলেনি মালবিকা। বস্টন থেকে ই-মেলে তার উত্তর, ‘‘স্কুল ছেড়ে বাড়িতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশুনো শুরু করার পরেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ব্যাপারটা ভাল লেগে যায়। তার পর শুধুই ওটা নিয়ে পড়ে গিয়েছি।’’ হাতেনাতে তার ফলও পেয়েছে সে। প্রোগ্রামিং অলিম্পিয়াডে দু’বার দ্বিতীয় এবং এক বার তৃতীয় হয় মালবিকা। আর তাতেই শিকে ছেঁড়ে এমআইটি-র। স্কুল-কলেজের ডিগ্রি নয়, সে দেশে এখনও মেধাকে মান্যতা দেওয়ার রেওয়াজ আছে। এমনটাই মনে করছেন সুপ্রিয়াদেবী। আর এ দেশে? একমাত্র চেন্নাই ম্যাথেমেটিক্যাল ইনস্টিটিউটে (সিএমআই) স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশুনোর সুযোগ পেয়েছিল মালবিকা। যদিও সে পড়তে যাচ্ছে মার্কিন মুলুকেই।
মালবিকার এই স্বপ্ন-উড়ানকে আজ ব্যতিক্রমই বলছেন সিএমআই-এর শিক্ষক মাধবন মুকুন্দ। আর সুপ্রিয়াদেবীর কথা একটাই— ‘‘আমার শুধু মনে হয়েছিল, মেয়েটা যেন হাসিখুশি থাকে। প্রথাগত শিক্ষার থেকেও মনে আনন্দ থাকাটা অনেক বেশি জরুরি।’’
মেয়েকে ঠিক এ ভাবেই নিজের মনের মতো করে তৈরি করতে চেয়েছিলেন মা চন্দা। বলিউডি ছবি ‘নিল বাট্টে সন্নাটা’-র (২০১৬) চিত্রনাট্যে সেই মা কাজ করতেন লোকের বাড়িতে-বাড়িতে। কষ্ট করেই মেয়ে অপেক্ষাকে স্কুলে পাঠাতেন। কিন্তু মেয়ের তাতে মতি ছিল না। বাধ্য হয়ে তাই মা-ও ভর্তি হয়ে যান স্কুলে। একই ক্লাসে— দু’জনে সহপাঠী। মাকে দেখে, আর ঠেকে শেখে মেয়ে। মায়ের স্বপ্নে ভর করেই স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে অবশেষে ইউপিএসসি পরীক্ষায় উতরোয় অপেক্ষা। তিতিবিরক্ত হয়ে এক সময় যে কি না স্কুলটাই ছাড়তে চেয়েছিল!
আর বাস্তবের মালবিকা?
বছর চারেক আগে স্কুলের পাট চুকিয়ে সে যেন এখন সেই স্বপ্ন-উড়ানেরই মাঝপথে।