দানিশ-স্মরণ। শনিবার দিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ
কাজ থেকে ফেরার সময়ে ছেলের জন্য অপেক্ষা নতুন নয় প্রবীণের কাছে। সেই ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে কখনও যে এ ভাবে তৎপর হতে হবে, ভাবেননি আখতার সিদ্দিকি। শনিবার বিকেলে দিল্লি থেকে দানিশ সিদ্দিকির বাবা ফোনে বলছিলেন, ‘‘ওকে কিন্তু ‘বডি’ বলবেন না। আসলে নিজের ছেলে তো, তাই এখনও ঠিক ‘দেহ’ বলে ভাবতে পারছি না!’’
ছেলেকে শেষ বারের মতো দিল্লিতে ফেরাতে বিদেশ মন্ত্রকের কাছে আর্জি জানিয়েছেন পুত্রহারা প্রবীণ অধ্যাপক। রাত পর্যন্ত অবশ্য ফেরেননি কফিনবন্দি দানিশ। কন্দহরে দানিশের মৃত্যুর সংবাদটি দিল্লিতে পৌঁছলেও এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ি ফেরা হয়নি দানিশের স্ত্রীরও। অন্যত্র ছিলেন তিনি। প্রবীণ আখতার সাহেবকেই সদ্যপ্রয়াত বড় ছেলের দুই সন্তানকে আগলে রাখতে হচ্ছে সঙ্কটকালে।
যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত তরুণ চিত্রসাংবাদিকের ঘনিষ্ঠজনেরা সকলেই একটা বিষয়ে একমত। ‘‘পেশার প্রতি শতকরা ১০০ ভাগ দায়বদ্ধ ছিলেন দানিশ। তাঁর দায়বদ্ধতায় কোথাও এতটুকু ফাঁক ছিল না। কিন্তু তা বলে অহেতুক দুঃসাহসের স্পর্ধায় কখনওই হাঁটতেন না তিনি,’’ এ দিনই বলছিলেন দানিশের পড়শি, ছোটবেলার বন্ধু বিলাল জ়াইদি। দানিশ ও বিলাল দশ বছর বয়স থেকে বন্ধু। এক সময়ে বিলালও সাংবাদিকতা করেছেন। এখন একটি স্টার্টআপ সংস্থার কর্ণধার। বিলালের কথায়, এই মৃত্যু এক নিষ্ঠুর ‘আয়রনি’ তাঁর কাছে। বললেন, ‘‘এই সমাজমাধ্যমের রমরমার দিনে অনেক সময়েই সাংবাদিকেরা তাঁদের কাজকে ছাপিয়ে বিশেষ হয়ে উঠতে চান। দানিশের তো অজস্র ছবিই ভাইরাল হয়। কিন্তু পরিমিতিবোধের মাত্রা নিয়ে ওর বোধটা সাংঘাতিক টনটনে ছিল। নিজেকে নিয়ে বাড়তি কিছু ভাবত না। হয় তো সে জন্যই ঠিক সময়ে খবরের কাছে পৌঁছে যেতে পারত। অথচ ওকেই এত বড় দাম দিতে হল।’’
বন্ধু বিলালের সঙ্গে দানিশের শেষ কথা কিছু মাস আগে। দানিশ তখন ক্যামেরা কাঁধে কোভিড কভার করতে উত্তরাখণ্ডে। বিলাল জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ওখানে কেন? আসল খবর তো দিল্লিতে! দানিশ বলেন, তিনি সহমত নন। দেশের রাজধানী নয়, অতিমারির এই সময়ে গ্রামীণ ভারতের ছবিটাই তাঁর কাছে প্রকৃত বাস্তব।
সুহৃদেরা জানতেন, খবরের কাছে বা খবরের মধ্যে থাকার থেকে বেশি ভাল আর কিছুতে থাকতেন না দানিশ। হয় তো সে জন্যই বাস্তবের ভয়ানকতম
মুহূর্তটা অশেষ সংবেদনশীলতায় লেন্সে ধরতে পারতেন তিনি। হয় তো তাই দিল্লি সংঘর্ষের সেই ভয়াবহ মুহূর্ত বা রোহিঙ্গা শরণার্থী মহিলার সাগর পেরিয়ে মাটি ছুঁয়ে জীবনের কাছে ফেরার সেই আবেগ— দু’টোই অনায়াসে স্পর্শ করতেন দানিশ।
আখতার সাহেব বলছিলেন, ‘‘ওর তো এই মাসের শেষেই ফেরার কথা ছিল। আফগান সেনাবাহিনীর সঙ্গে এমবেডেড চিত্রসাংবাদিকের ভূমিকা নিয়ে এক ফোঁটা চিন্তা ছিল না ছেলেটার!’’ বাবা-ছেলের শেষ কথা বুধবার। সে দিন দানিশের কণ্ঠ যেন ক্লেদহীন ফুরফুরে হাওয়া, ঝলমলে রোদ্দুর। ‘‘ছেলেটা কথা বলছিল। তাতে কোথাও কোনও উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা ছিল না। আর চোরা ভয়টয়ের কথা বলার ছেলেই ছিল না দানিশ। সেই মুহূর্তটা যদি বাঁধিয়ে রাখা যেত!’’
সদ্য পুত্রহারা পিতার স্বরে যেন ক্রান্তিকালের এক মহাকাব্যিক চরিত্র।