গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রায় এক রকম দেখানোর চেষ্টা হলেও আদতে ঠিক তেমনটা নয়। গত বছর হিউস্টনে ৫০ হাজার প্রবাসী ভারতীয়ের সম্বর্ধনায় ভাসা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত ধরে স্টেডিয়াম ঘুরেছিলেন, তখন তাঁর পিছনে ছিল মোদী-ঘনিষ্ঠ, বিজেপির বহির্বিশ্ব বিষয়ক অন্যতম চেনা মুখ, বিজয় চৌথাইওয়ালের উদ্যোগ আর ‘দ্য টেক্সাস ইন্ডিয়া ফোরাম’-এর সংগঠন।
আর এ বার আমদাবাদে ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প নাগরিক অভিনন্দন সমিতি’র বিপুল আয়োজন। প্রথমটি মুখ্যত, একটি প্রবাসী নাগরিক সংগঠনের ব্যবস্থাপনা। যার সঙ্গে মার্কিন সরকার ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই বললেই চলে। কিন্তু আমদাবাদের অনুষ্ঠানে ছত্রে ছত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব অতি স্পষ্ট। অস্যার্থ, দু’টি অনুষ্ঠানই আদতে মোদী-সমর্থকদের দ্বারা আয়োজিত। শেষের ক্ষেত্রে তার সঙ্গে রয়েছে সরকারের প্রবল যোগ।
বলা বাহুল্য, কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির সমর্থকরা চাইবেন, যেমনটা চৌথাইওয়ালে বলেছেন, হিউস্টনে দুই নেতার মিলিত ‘রসায়ন’ যে বীজ বপন করেছিল, সেটাই আমদাবাদে ‘ফল’ ফলাবে। এমনটাই কেন্দ্রের সরকার ও শাসক দলের চাওয়া, বিশেষত যখন ভারতীয় অর্থনীতির প্রধান নাবিকটি ‘হাল ভেঙে হারায়েছে দিশা’।
স্মৃতি সততই সুখের। ‘জি-২০’ জোটের বৈঠকে, হিউস্টনের স্মৃতি রোমন্থন।
ধন্য আশা কুহকিনী!
শুধুই সরকার নয়, প্রায় সকলেই চাইবেন এই শুভেচ্ছা সফরে ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হবে। সর্ব ক্ষেত্রে ব্যর্থ অর্থনীতির মরা গাঙে নতুন জোয়ার বইবে। যদিও, সে গুড়ে যে বালি, তা ট্রাম্প মশাই, কিছু দিন আগেই স্পষ্ট করেছেন। জানিয়েছেন, তাঁদের শর্ত মেনে আমেরিকার বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির জন্য ভারতের বাণিজ্য কানন পুরোপুরি উন্মুক্ত না করলে, বাণিজ্যিক চুক্তি নৈব নৈব চ!
বাণিজ্য না হলেও অন্তত সেই সব সরকারি নীতির ক্ষেত্রে অন্তত ট্রাম্পকে পাশে পাওয়া যাবে, এমন আশাও ছিল। ‘ঘরোয়া’ হলেও যা নিয়ে বিতর্কের অভিঘাত দেশ পেরিয়ে ‘আন্তর্জাতিক’!
আরও পড়ুন- ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বড়াই জিইয়ে রাখতে ফের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন মোদী
আরও পড়ুন- মার্কিন নির্বাচনে গুজরাতিরা ‘ফান্ড রেইজার’ বলেই কি মোদীর রাজ্যে আগে পা ট্রাম্পের?
কিন্তু সত্যিই কি শেষমেশ সেই আশাও ফলবে? যে বহুচর্চিত সরকারি নীতিগুলি নিয়ে এত কথা, সেগুলি হল: প্রথমত, সংবিধানে কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ বিষয়ক ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিল করা তথা জম্মু ও লাদাখ থেকে কাশ্মীরকে আলাদা করা ও তার ‘রাজ্য’-এর মর্যাদা লোপ করা। সেখানকার আইনসভা ভেঙে দেওয়া। এর পাশাপাশি, কাশ্মীরের সব প্রধান রাজনৈতিক নেতাকে বিনা বিচারে গৃহবন্দি করে রাখা। ফলে, রাজনৈতিক প্রশাসনকে সম্পূর্ণ অকেজো করে রাখা ও একই সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা স্তব্ধ করে রেখে মানুষকে তথ্য জানা ও মত বিনিময় থেকে বঞ্চিত করা।
এর সঙ্গেই আসে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) কথা। অসমে যা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ লাগু করতে গিয়ে প্রচুর মানুষকে সীমাহীন বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েও ভারতের সর্বত্র এনআরসি চালু করব বলে অহরহ আস্ফালন শোনা যাচ্ছে।
তৃতীয়ত, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে (সিএএ) পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারতে আশ্রয় নেওয়া (মুসলিম বাদে) হিন্দু-সহ ছ’টি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা। যা সংবিধানে প্রদত্ত সাম্যের অধিকার (বিশেষত, ১৪ এবং ১৫(১) ধারার)-এর পরিপন্থী বলেই অনেক বিশেষজ্ঞের মত।
‘ইউ’ অ্যান্ড ‘আই’। বন্ধুকে স্বাগত জানাতে তৈরি মোদীর রাজ্য গুজরাত
চতুর্থত, দশকওয়ারি পুরনো জনসংখ্যা গণনার বদলে নতুন জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি (এনপিআর) চালু করা, যেখানে একটি অঞ্চলের ‘স্থায়ী বাসিন্দা’দের তাঁদের বাবা-মায়ের জন্মস্থান ও তারিখের উল্লেখ করতে হবে। করাটা অবশ্য বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু যিনি/যাঁরা এই হদিশ দিতে পারবেন না, তাঁদের নামের পাশে ইংরেজি ‘ডি’ অর্থাৎ ‘সন্দেহজনক’ লেখা থাকবে। এই ‘সন্দেহ’-এর যথাযথ নিরসন করতে না পারলে, এনআরসি-তে নাগরিক হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত হবে না। ঠাঁই হতে পারে ডিটেনশন ক্যাম্পে!
আলোচনায় ডেমোগ্রাফিক রাজনীতি
সুতরাং, সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক চর্চা ও প্রয়োগের কেন্দ্রে এখন জনসংখ্যাকেন্দ্রিক বা ‘ডেমোগ্রাফিক’ রাজনীতি, যা ধর্মীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক জনবিন্যাসগত চরিত্র বিশ্লেষণ করে মুখ্যত মুসলিম সংখ্যালঘু ও কিছুটা বাংলাদেশ থেকে আগত যে কোনও সম্প্রদায়ের মানুষেরই উৎস ও পরিচয় বাজিয়ে দেখতে চায় এবং পছন্দমতো সদুত্তর না পেলে এই সব নাগরিকের বিরুদ্ধে আটকমূলক আইন প্রয়োগ করতে চায়। একটু অন্য ভাবে বললে, ভারত-ভাগের আগে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে যে চরম অবিশ্বাস ও বিভাজনের বিষাক্ত আবহাওয়া সমাজকে সার্বিক অর্থে কলুষিত ও পঙ্গু করেছিল, নবোদ্যমে প্রায় সেই জায়গায় দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলেছে।
কাশ্মীরের ব্যাপারেও একই কথা। সেখানকার পরিস্থিতি মাঝে মাঝেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে গত তিন দশক ধরে। এর পিছনে শুরু থেকে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতের কথা সকলেরই জানা। গত তিন দশকে, সোভিয়েত শিবিরের পতনের পর, এশিয়ার নানা জায়গায়, বিশেষত আফগানিস্তানে, ইসলামি মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান হওয়ায় যা আরও ঘোরালো হয়েছে। মুশকিল হয়েছে, এর সঙ্গে (রাজনৈতিক প্রণালী মাঝে মাঝেই ব্যর্থ হওয়ায়) নতুন করে যুক্ত হয়েছে যুবকদের মধ্যে ‘স্বতন্ত্র’ হওয়ার উন্মাদনা।
কিন্তু কেবল সামরিক দমনপীড়নেই কি জন্মলগ্ন থেকে সূচিত এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব? সামরিক পন্থার পাশাপাশি এখানেও সরকার জনবিন্যাসগত বিভাজন করছে। হিন্দুপ্রধান জম্মু ও বৌদ্ধপ্রধান লাদাখের থেকে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করে।
কিছু তেতো কথা...
এই সব কিছু নিয়েই ঘরে-বাইরে নানা রঙের রাজনীতি প্রবাহিত হচ্ছে। দেশের নানা জায়গায় এনআরসি, সিএএ, এনপিআর-এর বিরোধিতা চলছে। রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক, দু’ভাবেই। কেবল মুসলিমরাই নন, অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষও সহমর্মিতা জানাচ্ছেন। আর, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুখ্যত পাকিস্তান-সহ কয়েকটি ইসলামি দেশ কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’র অবলুপ্তি, রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ স্তব্ধতা প্রভৃতি নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে চেষ্টা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি উদার গণতন্ত্রের মধ্যেও এই নিয়ে আওয়াজ উঠছে এবং শোনা যাচ্ছে, এ বার ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর আলো ঝলমলে মঞ্চে যখন নৃত্যগীতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বরণ করা হবে, তখন ‘ব্যাক স্টেজ’-এ বসে মোদীর পরম সুহৃদ ট্রাম্প এই সব ‘অপ্রিয়’ বিষয়ের উত্থাপন করে তাঁর ভারতীয় বন্ধুটিকে দু’দেশের প্রাচীন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ কথা বলতে পারেন যে, ‘ধর্মীয় সহিষ্ণুতা’ গণতন্ত্রের অচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং কাশ্মীরেও গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার একান্ত কাম্য।
আরও পড়ুন- ভারতে এসে বাণিজ্যে লাভ হবে না, বুঝে গিয়েছেন ট্রাম্প
এর আগেও ট্রাম্প কাশ্মীর বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে চেয়েছেন। কেবল ট্রাম্পই নন, ১৯৫০-এর দশক থেকে এতাবৎ বহু পশ্চিমি নেতাই এই কাজ করতে চেয়েছেন। কেনেডি থেকে ক্লিন্টন, ওবামা থেকে ট্রাম্প, প্রায় সকলেই, নিজের নিজের মতো করে। যদিও ভারত বরাবরই কাশ্মীরের ব্যাপারে অতি সংবেদনশীল। নানা সরকার বদলালেও নতুন দিল্লি বরাবরই বলে এসেছে কাশ্মীর ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়। তৃতীয় কোনও পক্ষের হস্তক্ষেপ সে মানবে না।
রাজনীতির ‘খেলা’ থেকে স্টেডিয়ামে। উদ্বোধনেও থাকবেন দু’জন। তৈরি মোতেরা।
তৎপরতা কেন?
এ কথা আমেরিকাও জানে। তবু কেন এ বারের তৎপরতা?
ওয়াকিবহাল সূত্রের মতে, আসলে ট্রাম্প চাইছেন বহু দশকের যুদ্ধ-ক্লান্ত মার্কিন সেনাদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু এই ‘সরিয়ে নেওয়ার’ মূল্য হতে পারে মার্কিন (এমনকি, ভারতীয়ও) স্বার্থের পক্ষে মারাত্মক। মার্কিন সেনা চলে গেলেই সেখানে অবশ্যম্ভাবী দাপাদাপি বাড়াবে এখন কিছুটা দমে থাকা মৌলবাদী তালিবানরা। যার মোকাবিলা করার শক্তি কাবুলের নির্বাচিত সরকারের নেই। অতএব প্রয়োজন, এমন একটা স্থানীয় শক্তির, যারা তালিবানকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারে। বিশেষত, এ বার দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে জয় সুনিশ্চিত করতে ট্রাম্পের প্রয়োজন আফগানিস্তান-সহ দক্ষিণ এশিয়ায় ‘শান্তি’ বজায় রাখা। এই কাজ করতে পারে তারাই, যাদের সঙ্গে তালিবানদের কিছুটা আস্থার সম্পর্ক আছে। বলা বাহুল্য, এই শক্তি হল পাকিস্তান ও তার গুপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। ট্রাম্প ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে পাকিস্তান হয়তো সহায়তা করবে। আর তার জন্য ‘আর্থিক সহায়তা’র নাম করে প্রচুর উপঢৌকনও পাবে। কিন্তু কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি তথা ভারতে জনবিন্যাসগত রাজনীতি ও প্রতি-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তারা এই সব কিছুর ব্যাপারেও ট্রাম্পের আশ্বাস চায়।
তাই সম্ভাবনা রইল, প্রকাশ্য মঞ্চে না হলেও, গেস্ট রুমে বসে ধোকলা আর চাটনি চাখতে চাখতে ট্রাম্প মশাই তাঁর ভারতীয় বন্ধুটির কানে কানে হয়তো এই সব কথাও এক সময় পেড়ে ফেলবেন। বন্ধুবরের পক্ষে তা কড়া এবং তেতো ঠেকলেও!
লেখক বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ফাইল ছবি