গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সম্পর্কটা কেমন ছিল? আর ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কটা এখন কোন জায়গায় পৌঁছেছে? এটা ভাল ভাবে বোঝা যায়, স্বাধীনতার পর ভারতে মার্কিন প্রেসিডেন্টদের পা রাখার ঘটনাগুলির উপর নজর রাখলে।
১৯৪৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ভারত সফরে এসেছিলেন তিন জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ১১ বছর পর এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার। সেটা ১৯৫৯ সাল। তার পর একটি দশকের ব্যবধান। ১৯৬৯-এ ভারতে এসেছিলেন তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। আর তার ৯ বছর পর, ১৯৭৮-এ ভারতে এসেছিলেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার।
তার পর টানা ২২ বছর আর কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতে আসেননি। কিন্তু সেই হাওয়া বদলাল ২০০০ সাল থেকে। গত ২০ বছরে যিনিই মার্কিন প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসেছেন, তিনিই ভারতে এসেছেন সরকারি সফরে। পূর্বতন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারতে এসেছিলেন দু’বার। ২০১০ আর ২০১৫-য়।
২০০০ সাল থেকে বিশ্ব পরিস্থিতিটাই অনেক বদলে গিয়েছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্কের রসায়ন তো বদলেছেই, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতিও তার আগের দশকের চেয়ে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পরেই আগের নির্জোট বিদেশনীতির পথ ছেড়েছে ভারত। পরমাণু অস্ত্রের সফল পরীক্ষা করেছে। অর্থনীতির উদারীকরণ হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে হয়ে উঠেছে একটি উদীয়মান দেশ।
পরিবর্তনের প্রয়োজন হল কেন?
ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি। যা আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিকে বদলে দিয়েছে। এতটাই যে, আমেরিকা চিনকে রাশিয়ার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক বলে দেখতে শুরু করেছে। ফলে, দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনীতি ও কুশলী অংশীদারির (‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’) ক্ষেত্রে আমেরিকার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভারত।
আরও পড়ুন- ভারতে এসে বাণিজ্যে লাভ হবে না, বুঝে গিয়েছেন ট্রাম্প
আরও পড়ুন- ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বড়াই জিইয়ে রাখতে ফের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন মোদী
সেই শুরুটা হয়েছিল ২০০০-এ। তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের ভারত সফরের মাধ্যমে। সেই সময় ভারতে কার্যত ‘রকস্টার’-এর মতো অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন ক্লিন্টন।
২২ বছর পর সেই শুরু। নতুন বার্তা নিয়ে ভারতে এলেন তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন।
সেই ধারা বজায় থেকেছিল পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ (জুনিয়র)-এর ভারত সফরের সময়। ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে নতুন একটা মাত্রা দিয়েছিলেন বুশ। ২০০৫-এ তাঁর ভারত সফরের পরেই অসামরিক ক্ষেত্রে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে পরমাণু চুক্তি হয়। সেই সময় ওই চুক্তির বিরোধিতা যেমন ছিল আমেরিকার অন্দরে, তেমনই মার্কিন মিত্র কয়েকটি দেশও চায়নি, ভারতের সঙ্গে ওই চুক্তি হোক। কিন্তু বুশের আন্তরিকতায় কোনও বাধাই ধোপে টেকেনি সেই সময়। চুক্তি হয়েছিল।
ভারতকে কাজে লাগবে! ৫ বছর পর ভারতে পা তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট বুশের। ২০০৫-এ।
তার পর এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দু’-দু’বার এসেছিলেন ভারতে। ২০১০ এবং ২০১৫-য়। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের ভারতে পদার্পণের মধ্যে এখনও পর্যন্ত ওবামার সফরকেই সবচেয়ে সফল বলে মনে করা হয়। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কুশলী অংশীদারির ক্ষেত্রে আমেরিকা যে ভারতকে যথেষ্টই গুরুত্ব দিতে চাইছে, তা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওবামার সফরেই।
ভোটের বছরে ভারতে ট্রাম্পই প্রথম কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট
ভারত সফরের নিরিখে ডোনাল্ড ট্রাম্প সপ্তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর ২০০০-এ ক্লিন্টনের সফরের পর চতুর্থ। ক্লিন্টন ও তাঁর উত্তরসূরীদের মতো ট্রাম্পের সফরও সমসাময়িক ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে। তবে ট্রাম্পের আগে যে ৬ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারত সফরে এসেছিলেন, তাঁরা কেউই কিন্তু নিজের দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে এ দেশে আসেননি। তা-ও আবার সেই সময়ে, যখন তিনি দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হতে চাইছেন। এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যাতিক্রমই।
এলেন ভারত-বন্ধু। পূর্বতন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ২০১৫-য়, তাঁর দ্বিতীয় সফরে।
তাই আশা করা যায়, ট্রাম্পের এই সফরের উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে এমন কিছু থাকবে যা নিছকই দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার লক্ষ্যে নয়। তার চেয়ে আরও কিছু বেশি। যার মধ্যে অন্যতম ‘স্ট্র্যাটেজিক লিস্নিং’। মানে দু’দেশের মধ্যে কুশলী অংশীদারির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। আলোচনা করা।
ভারত তখন নেই মার্কিন নেকনজরে। সফরে এলেন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। ১৯৭৮-এ।
ট্রাম্প ‘আনপ্রেডিক্টেব্ল’, তাই তাঁর সফরে থাকে কৌতূহলও!
আবার এটাও ঠিক, অতীতে দেখা গিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিদেশ সফরে যতটা কাজ হওয়ার কথা থাকে, ততটা হয় না। বা, সফরের ফলাফল সম্পর্কে অনুমান সফরের শেষে গিয়ে মেলে না। অথবা, তিনি যে দেশে সরকারি সফরে যেতে পারেন বলে মনে করা হয়, সে দেশে হয়তো গেলেনই না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। গেলেন অন্য দেশে, যেখানে যাবেন বলে কেউ প্রত্যাশাও করেননি।
খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও ট্রাম্পই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি উত্তর কোরিয়ায় গিয়েছিলেন। আর উত্তর আমেরিকায় প্রতিবেশী দুই দেশ কানাডা ও মেক্সিকোয় না গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। আবার ডেনমার্ক সফর বাতিল করে দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তিনি গ্রিনল্যান্ড কিনে নিতে পারেন বলে রটনার জেরে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী ফ্রেডরিকসেন বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন বলে। বিদেশ সফরের সময় ট্রাম্প যে সব টুইট করেন, বা ভাষণ দেন বা প্রকাশ্যে কিছু বলেন, তার মধ্যেও থাকে এমন সব বিষয়, যা অভাবিত। কেউ কল্পনাও করতে পারেন না!
২০১৮-র জুলাইয়ে ব্রাসেলসে ‘ন্যাটো’ জোটের শীর্ষ সম্মেলনে ট্রাম্প প্রকাশ্যেই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে-কে ‘নির্বোধ’ বলেছিলেন। আমেরিকায় ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতকে ‘পাগলাটে’ বলেছিলেন। কাজগুলিও করেন অদ্ভূত রকমের। জেরুসালেমকে ইজরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেন, ‘ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি)’ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, কিউবার সঙ্গে সম্পর্ককে ফের তিক্ত করে তোলেন। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির প্রেক্ষিতে বেরিয়ে আসেন ‘জেসিপিওএ’ চুক্তি থেকে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে শান্তির নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, ইজরায়েলকে সমর্থন করে। স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের দাবিকে নস্যাৎ করে জেরুসালেম ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ ইজরায়েলকে দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ট্রাম্পের এই সব কাজকর্ম ভারতকে খুশি করতে পারেনি। এমন উদাহরণ আরও আছে।
ট্রাম্প তাই অন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মতো নন। তাঁর কাছ থেকে কূটনৈতিক সৌজন্যের প্রত্যাশা ততটা করা যায় না। তিনি কী করবেন, তা আগেভাগে সঠিক ভাবে বোঝাও যায় না।
ট্রাম্পের সফরের সম্ভাব্য ‘অ্যাজেন্ডা’
ভারত সফরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘অ্যাজেন্ডা’ কী হতে পারে?
ট্রাম্পের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি। আর এ ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও একেবারেই স্বতন্ত্র। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর প্রথম ভাষণে ট্রাম্প বলেছিলেন, বিদেশনীতি ও অন্য দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যেও অগ্রাধিকার পাবে তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি। যার মোদ্দা কথা, অন্য দেশগুলিতে মার্কিন পণ্য রফতানির পরিমাণ বাড়ানো, যে কোনও মূল্যে। সেই সময় ‘উগ্র মুসলিম সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধেও বিশ্বকে একজোট করার অঙ্গীকার করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পরে দেখিয়েছেন, সেটা তিনি খুব তড়িঘড়ি করতে চান। মূলত দু’ভাবে। প্রথমত, কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিকদের উপর আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দ্বিতীয়ত, অন্য দেশের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর শুল্কের বোঝা যতটা সম্ভব বাড়িয়ে।
সেই ট্রাম্প ভারতে আসছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই প্রথম। আর তাঁর নিজের দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে। ফলে, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখন ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার উপর একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। আরও একটা কারণ, কুশলী অংশীদারি ছাড়া দু’দেশের সম্পর্কে আর যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি রয়েছে, সেটা হল; বাণিজ্যিক সম্পর্ক।
ট্রাম্প জমানায় বেড়েছে ভাবসাব, ডলারের নিরিখে!
২০১৮-’১৯ অর্থবর্ষে আমেরিকায় ভারতের রফতানির পরিমাণ ছিল ৫২.৪ বিলিয়ন (এর বিলিয়ন মানে, ১০০ কোটি) ডলার। আর মার্কিন পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৫.৫ বিলিয়ন ডলার। তার মানে, বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১৬.৯ বিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবর্থ ২০১৭-’১৮-য় যে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২১.৩ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমেছে।
এ বার তাকানো যাক প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) দিকে। ভারতে মার্কিন পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ ২০১৭-’১৮-য় ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। যা ২০১৮-’১৯ অর্থবর্ষে বেড়ে হয়েছে ৩.১৩ বিলিয়ন ডলার।
ভারতে আমেরিকার শক্তি (এনার্জি) রফতানির পরিমাণ ওই একই সময়ে শূন্য থেকে বেড়ে গত বছর ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ২০১৭ সালে ভারত আমেরিকা থেকে অপরিশোধিত তেল কিনত ৯৬ লক্ষ ব্যারেল। সেটা ২০১৮-য় বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৮২ লক্ষ ব্যারেল।
শক্তি ক্ষেত্রের অংশীদারিও দু’দেশের মধ্যে কুশলী অংশীদারির স্তরে উন্নীত হয়েছে। যাকে বলা হয়, ‘স্ট্র্যাটেজিক এনার্জি পার্টনারশিপ (এসইপি)’। যেখানে মূলত চারটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। তেল ও গ্যাস, বিদ্যুৎ ও শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা-বৃদ্ধি, অপ্রচলিত শক্তি এবং সাসটেনেব্ল গ্রোথ।
ভারতকে কিছু যুদ্ধবিমান ও অত্যন্ত গোপনীয় সামরিক প্রযুক্তি বিক্রিরও তোড়জোড় শুরু করেছে আমেরিকা, যা এর আগে কখনও হয়নি।
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বনাম ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’
কিন্তু ট্রাম্প মনে করেন, যে সব দেশ তাদের পণ্যাদি আমেরিকায় বেশি পরিমাণে বেচে মার্কিন পণ্যাদি নিজের দেশে কম ঢুকতে দেয়, তারা আদতে আমেরিকাকে ঠকাচ্ছে। তাই ভারতে যাতে আরও বেশি পরিমাণে মার্কিন পণ্য ঢোকে, তার চেষ্টা চালাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। তার মধ্যে রয়েছে কৃষিপণ্য, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, দুগ্ধজাত দ্রব্য। আর সেটা তখনই হচ্ছে যখন ভারতে আর্থিক মন্দা চলছে, বেকারি বাড়ছে। তার ফলে, নিজেকে বাঁচাও নীতি নিয়ে চলতে হচ্ছে মোদী সরকারকে। এ বারের বাজেটে তাই খেলনা, চটি থেকে শুরু করে গাড়ি ও যন্ত্রপাতি, সব রকমের আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এটা অনেকটা যেন ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির পাল্টা- ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি।
নানা রকমের বিরোধ-বিবাদের ফলে গত কয়েক বছর ধরে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ফি-বছরের বাণিজ্য বৈঠকও (‘ট্রেড পলিসি ফোরাম’) নিয়মিত ভাবে হচ্ছে না। ২০০৫ সাল থেকে এই বৈঠক শুরু হয়েছিল। তাই দেখতে হবে, ট্রাম্পের ভারত সফর সেই বরফ গলাতে পারে কি না।
কেন ভোটের বছরে ভারতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট?
আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরেই ভারতে আসছেন ট্রাম্প। এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটা হচ্ছে রিপাবলিকানদের শক্ত ঘাঁটি হিউস্টনে ট্রাম্পের সমর্থনে গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটি সমাবেশের (‘হাউডি মোদী’)-এর কয়েক মাসের মধ্যেই। ওই সমাবেশে সব প্রোটোকল ভেঙে প্রধানমন্ত্রী মোদী মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমর্থনে আমেরিকায় থাকা ভারতীয়দের সমাবেশে স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আব কি বার, ট্রাম্প সরকার (এ বারও ট্রাম্প সরকারই)’।
বন্ধু ট্রাম্পের জন্য হিউস্টনে। ‘হাউডি মোদী’ সমাবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী। গত বছর।
কেন দিল্লিতে নয়, ট্রাম্প প্রথমে পা ছোঁয়াবেন মোদীর রাজ্যে?
তাই এটা বিস্ময়ের নয় যে, এ বার তাঁর ভারত সফরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাজধানী দিল্লিতে প্রথমে না এসে মোদীর রাজ্য গুজরাতকেই বেছে নিয়েছেন। যাচ্ছেন আমদাবাদে। সেখানে তিনি মোদীর ‘আইডল’ বল্লভভাই পটেলের নামাঙ্কিত একটি স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করবেন মোতেরায়। সেখানে ট্রাম্পের অভ্যর্থনায় হবে একটি অনুষ্ঠান, প্রথমে যার নাম দেওয়া হয়েছিল, ‘কেম চো ট্রাম্প’। গুজরাতি ভাষায়। গত বছর হিউস্টনে আয়োজিত ‘হাউডি মোদী’র ধাঁচে। পরে অবশ্য সেই নাম কিছুটা সংশোধন করা হয়েছে। নতুন নাম, ‘নমস্তে ট্রাম্প’। জাতীয় প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে। অথচ, এই ধরনের কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি দেশের রাজধানী দিল্লিতে। যেখানে ট্রাম্প শীর্ষ স্তরের বিভিন্ন সরকারি বৈঠকগুলি করবেন।
কেন? সেটা কি ট্রাম্পের জন্যই? আমেরিকায় থাকা গুজরাতি ভোটারদের কাছে টানতেই? আমেরিকায় থাকা এই গুজরাতিরা যথেষ্টই সম্পদশালী। এটা ঠিকই, আমেরিকায় থাকা ভারতীয়দের ভোট প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে হয়তো ট্রাম্পের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তা মোট মার্কিন জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ। তারও অর্ধেক শতাংশ ভোটার। শুধু তাই নয়, আমেরিকায় ভারতীয়দের বেশির ভাগই থাকেন মূলত ইলিনয়, ক্যালিফোর্নিয়া এবং উত্তর-পূর্বের প্রদেশগুলিতে। যেখানে মূলত ডেমোক্র্যাটদেরই আধিপত্য। কিন্তু আমেরিকায় যে গুজরাতিরা থাকেন, তাঁরা অত্যন্ত সম্পদশালী। মার্কিন ভোটে রাজনৈতিক দলগুলির প্রচার তহবিলে তাঁরা প্রচুর অর্থ দেন।
তাঁদের কাছে টানতে আমেরিকায় অনেক হিন্দু সংগঠন গজিয়ে উঠেছে। যেমন, ‘রিপাবলিকান হিন্দু কোয়ালিশন’। যারা ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন-বিরোধী নীতির সমর্থনে ওয়াশিংটনে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেছিল। এ ছাড়াও রয়েছে ‘হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশন’ ও ‘ভিএইচপি আমেরিকা’। আমেরিকায় মুসলিম অভিবাসীদের সম্পর্কে ট্রাম্পের বিশেষ বীতস্পৃহা এই সংগঠনগুলিকে আরও উৎসাহিত করে তুলেছে। আমেরিকায় এই সব হিন্দু সংগঠনের শক্ত ঘাঁটি আবার হিউস্টনই।
আমেরিকায় থাকা ভারতীয়রা সাধারণত ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দিয়ে থাকেন। কিন্তু ২০১৬-র নির্বাচনে সেই নিয়মের কিছুটা ব্যাতিক্রম ঘটতে দেখা গিয়েছিল। ১৬ শতাংশ ভারতীয়ের ভোট পড়েছিল ট্রাম্পের ঝুলিতে। গুজরাতে ট্রাম্পের সফর কি আমেরিকায় থাকা সেই অত্যন্ত সম্পদশালী গুজরাতিদের আরও বেশি করে টানতে পারে এ বার ট্রাম্পের দিকে?
ভারত কি হাঁটবে চিন, জাপান, ইউরোপের দেখানো পথেই?
ট্রাম্প অবশ্য ভারত সফর করা অন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মতো নন। ক্লিন্টন, বুশ, ওবামারা চেয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক ও কুশলী অংশীদারির সম্পর্ক গড়ে তুলতে। সেই লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পথে হাঁটতে। ট্রাম্প কিন্তু তাৎক্ষণিক ফল পেতে চান। যেমন, আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে সাময়িক ইতি টানতে আমেরিকার কাছ থেকে সয়াবিন ও তেল কিনতে চেয়েছে চিন। একই ভাবে কয়েকটি মার্কিন পণ্যে শুল্ক-ছাড়ের পথে এগিয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপ। এই সবের মাধ্যমে হয়তো ওই দেশগুলি আমেরিকার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি, কিন্তু কিছুটা হলেও, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মন গলিয়েছে।
ভারতেরও তেমনই কিছু করা উচিত। আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির কথা মাথায় রেখে। আমেরিকার সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদের সামরিক সম্পর্ক, সহযোগিতা ও কুশলী অংশীদারির সম্ভাবনাকে আরও জোরালো করে তুলতে বা অন্তত জিইয়ে রাখতে। ট্রাম্প এই সময়েই ভারত সফরে আসছেন, যখন তাঁর নিজের দেশে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে আর তাঁর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বিরোধে-বিবাদে কিছুটা দিশাহারা। ভারতকে সেই কথাটা মাথায় রেখেই এই অঞ্চলে নিজের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সেটা করতে হবে।
লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
ফাইল ছবি