পরণে সাদা ধুতি আর সাদা কুর্তা। খালি পা, পিঠে গড়িয়ে পড়েছে কোকড়ানো, তেলতেলে লম্বা চুল। সম্বলপুরের রাস্তায় চানা-ঘুগনি বিক্রেতা এই ব্যক্তিকে অনেকেরই চোখে পড়ে না। বা অনেকে দেখেও চোখ ঘুরিয়ে চলে যান হয়তো!
তবে তাঁকে যতটাই হীন মনে করুন না কেন, পোশাক বা বাহ্যিক রূপ দিয়ে কিন্তু এই মানুষটিকে বিচার করা সম্ভব নয়। অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে জীবন কাটানো এই মানুষটির মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে এক গভীর প্রতিভা।
ইনি ভারতের এক জনপ্রিয় কবি। নাম হলধর নাগ। পদ্মশ্রী সম্মানও দেওয়া হয়েছে তাঁকে। অবাক লাগছে তো? তাঁর জীবন সংগ্রাম যত জানবেন, ততই আরও অবাক হয়ে উঠবেন।
যাঁর কলমে মুক্তো ঝরে পড়ে, তিনি মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। অভাবের তাড়নায় সেই ১০ বছর বয়স থেকেই শুরু হয় কঠিন-লড়াই। কখনও মিষ্টির দোকানে বাসন ধুয়ে, কখনও কোনও স্কুলে রান্না করে অর্থ উপার্জন করেছেন।
ওড়িষার সম্বলপুর থেকে ৭৬ কিলোমিটার দূরে বরগড় জেলা। এই জেলাতেই ১৯৫০ সালে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম তাঁর। মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারান। বাবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।
সে কারণে তৃতীয় শ্রেণির পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তাঁর। বরং খুব কম বয়সে প্রথমে একটা মিষ্টির দোকানে বাসনপত্র ধোওয়ার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে।
এর দু’বছর পর তাঁকে কাছের একটি স্কুলে পাঠানো হয়। তবে সেই স্কুলে পড়াশোনার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়নি, পাঠানে হয়েছিল স্কুলের রান্নার কাজের জন্য।
১৬ বছর ওই স্কুলের রাঁধুনি হিসাবে কাজ করেছেন তিনি। ওই এলাকায় যখন আরও অনেক স্কুল খুলতে শুরু করে, হলধর তখন ব্যাঙ্ক থেকে এক হাজার টাকা ঋণ নিয়ে স্কুলের বাইরে একটি ছোট স্টেশনারি দোকান চালু করেন।
তবে রান্নার কাজটাও ছাড়েননি। ছোট থেকেই তিনি কোসলী ভাষায় ছোটগল্প লিখতেন। যে জন্য তিনি এত জনপ্রিয় হয়েছেন, সেই কবিতা লেকা অবশ্য শুরু করেছিলেন অনেক পরে।
১৯৯০ সালে প্রথম কবিতা লেখার জন্য কলম ধরেন। ‘ধোদো বরগাছ’ অর্থাৎ বুড়ো বটগাছ নামে তাঁর প্রথম কবিতা স্থানীয় ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। আরও চারটি কবিতা লিখে পাঠান তিনি। সেগুলোও পরে ওই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
তাঁর সবকটি কবিতাই প্রশংসিত হয়। এর পর তিনি আরও কবিতা লিখতে শুরু করেন। ধর্ম, প্রকৃতি, সমাজ- এ রকম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন।
তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের এই ছেলের হাতে কলম যেন জাদুর মতো কাজ করত। সমাজে তিনি ‘লোক কবি রত্ন’ নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
এই মুহূর্তে তাঁর কবিতা নিয়ে পিইচডি করছেন পাঁচ জন। তাঁর সমস্ত কবিতা একত্রিত করে ‘হলধর গ্রন্থাবলী’ প্রকাশ করেছে সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ‘হলধর গ্রন্থাবলী’-এর দ্বিতীয় পর্বও প্রকাশ করতে চলেছে তারা।
২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন তিনি। ২০১৯ সালে তিনি সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেন।
কিন্তু কী আশ্চর্যের, জীবনযাত্রার কোনও বদল ঘটেনি এই কবির। এখনও আগের মতোই সেই অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করেন তিনি।
এখনও ওই ছোট দোকান থেকেই উপার্জন করে দিন গুজরান করেন। ওড়িষার রাস্তায় সাদা ধুতি গায়ে, খালি পায়ে মাঝে মাঝে চানা-ঘুগনিও বেচতে দেখা যায় তাঁকে। তাঁর স্ত্রীর নাম মালতি নাগ, তাঁদের একটি মেয়ে রয়েছে।