ফিরল জওয়ান বিশ্বজিৎ ঘোড়ইয়ের কফিনবন্দি দেহ। সোমবার কলকাতা বিমানবন্দরে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
উরি হামলার পরেই দাঁতের বদলে চোয়াল খুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতা রাম মাধব। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই মোদী সরকার বুঝতে পারছে, পাকিস্তানকে এই মুহূর্তে সামরিক পথে জবাব দেওয়া কার্যত অসম্ভব। সেনা কর্তারা আজ সরকারকে বুঝিয়েছেন, দু’টি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে কখনওই ‘নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধ’ করা সম্ভব নয়। তা অচিরে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত হবে এবং আন্তর্জাতিক মহলও একে মেনে নেবে না। এমনকী নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে জঙ্গি শিবির গুঁড়িয়ে দিতে হলে তার ফলাফল কী হতে পারে, তা-ও ভেবে দেখা দরকার বলে মত প্রকাশ করেছে সেনা। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আপাতত কূটনৈতিক স্তরেই ইসলামাবাদকে কোণঠাসা করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে নয়াদিল্লি।
উরি-র পাল্টা রণনীতি সাজাতে আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকর, অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, সেনাপ্রধান, গোয়েন্দাকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। ঠিক হয়েছে, হামলায় পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সংযোগের প্রামাণ্য নথি তুলে ধরা হবে বিশ্বের সামনে। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ২৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জে তাঁর বক্তৃতায় উরি-সন্ত্রাসকে জোরালো ভাবে তুলে ধরবেন। পাকিস্তানের আর্থিক মদতদাতা এবং বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রগুলির কাছে তথ্য ও নথি দিয়ে নয়াদিল্লি বলবে, সেখানে লগ্নি করার অর্থ হল সন্ত্রাসবাদের হাত শক্ত করা।
সন্ত্রাসে ইসলামাবাদের মদতের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্তর্জাতিক শীর্ষ মঞ্চে পাকিস্তানকে একঘরে করার কৌশল নিচ্ছে ভারত। তবে একই সঙ্গে তার লক্ষ্য কাশ্মীর সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণ এড়িয়ে চলা। মোদী সরকার ঠিক করেছে, উরিতে উদ্ধার হওয়া পাকিস্তানের মার্কামারা যাবতীয় প্রমাণ দুনিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হবে।
সেনার তরফে আজ জানানো হয়েছে, উরি ঘাঁটিতে হামলাকারীদের থেকে চারটি একে-৪৭, চারটি আন্ডার ব্যারেল গ্রেনেড লঞ্চার, ৩৯টি গ্রেনেড, ৫টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ২টি রেডিও সেট, ২টি জিপিএস, ২টি মানচিত্র, বিপুল পরিমাণে খাবার, ওষুধপত্র উদ্ধার হয়েছে। সেগুলিতে পাকিস্তানের ছাপ রয়েছে। এ থেকেই স্পষ্ট, জঙ্গিরা এসেছিল পাকিস্তান থেকে। যে মানচিত্র পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে পশতু ভাষায় লেখা রয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রমাণ হিসেবে এগুলি তুলে ধরা হবে।
এই প্রচারে ফল ফলবে বলেই আশাবাদী দিল্লি। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুন এ দিনই উরির হামলার নিন্দা করে দোষীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং বেজিং-ও আজ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে উরি-কাণ্ডের নিন্দায় সরব হয়ে সন্ত্রাসবাদকে আটকানোর ডাক দিয়েছে।
আরও পড়ুন: কলকাতা এ বার নতুন সাজে আনন্দ উৎসবে
তবে কাশ্মীর নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সরব হতে পাকিস্তানের প্রস্তুতিও থেমে নেই। নওয়াজ শরিফ শনিবারই আমেরিকায় পৌঁছেছেন। কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, এই অভিযোগ তুলে তিনি আগামী কাল রাষ্ট্রপুঞ্জে সরব হতে চাইছেন। পাক সরকারের তরফে আজ বলা হয়েছে, কাশ্মীরের উত্তাল পরিস্থিতি থেকে দুনিয়ার নজর ঘোরাতেই উরির ঘটনার দায় নয়াদিল্লি তাদের উপর চাপাতে চাইছে। কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ জানিয়ে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলিকে চিঠিও লিখেছেন শরিফ। কিন্তু উরির ঘটনার পরে রাষ্ট্রপুঞ্জে শরিফের আক্রমণ ভোঁতা হয়ে যাবে বলেই মনে করছে দিল্লি।
পুরোপুরি যুদ্ধে যেতে না পারলেও আজকের বৈঠকে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর শক্তি বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছে মোদী সরকার। পাকিস্তানের দিক থেকে সংঘর্ষবিরতি চুক্তি ভাঙা বা অনুপ্রবেশে মদত দেওয়ার ঘটনা ঘটলেই, জোরালো ভাবে জবাব দিতে বলা হয়েছে। তবে বিদেশ প্রতিমন্ত্রী ভি কে সিংহ আজ বলেন, আবেগতাড়িত হয়ে প্রত্যাঘাত করা হবে না। তাঁর কথায়, ‘‘ঠান্ডা মাথায় অঙ্ক কষে জবাব দেওয়াটাই এখন জরুরি।’’ যদিও কংগ্রেস ও বামেদের কটাক্ষ, মনমোহন-জমানায় নরেন্দ্র মোদী যে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রয়োজনের কথা বলতেন, পাকিস্তানকে প্রত্যাঘাতের কথা বলতেন, তা আজ কোথায় গেল?
আজ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান রাহিল শরিফও সে দেশের সেনাকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। পরে ভারতের উদ্দেশে তিনি বলেন, যাবতীয় হুমকির মোকাবিলা করতে তৈরি আছে পাকিস্তান।