কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শেষ। বুধবার বিকেলে দিল্লির এ কে গোপালন ভবনের সামনে থেকে সাদা অ্যাম্বাসাডরে উঠছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক সিপিএম নেতা। কলকাতা ফিরবেন। মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। ভাবখানা অনেকটা ‘কেমন দিলুম’!
অ্যাম্বাসাডরের মতোই জুরাসিক পার্কে ঢুকে পড়া একটি বিষয়ে তিনি বিতর্কে জিতেছেন। তাই তাঁর মুখে হাসি ধরছে না। পলিটব্যুরো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ১৯৭৮ সালে অ-কংগ্রেস মহাজোট তৈরির সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। কিন্তু তা হলে যে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকার চালানোটাই ভুল বলে ধরে নিতে হয়। তাই সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন আলিমুদ্দিনের ওই নেতা। পলিটব্যুরো নিজের অবস্থান থেকে সরে গিয়েছে। বাংলার বাম সরকারের ‘গৌরব’ রক্ষা হয়েছে। কিন্তু অতঃকিম?
দিল্লিতে এসে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এবার দ্বিখণ্ডিত। একদল ছিলেন প্রকাশ কারাটের সঙ্গে। আরেক দল গলা ফাটিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরির হয়ে। চার দিনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শেষে কারাট-ইয়েচুরির সমঝোতা সূত্র বেরিয়েছে। আলিমুদ্দিনের নেতাদের মধ্যে ফাটল জোড়া লাগবে কি?
সিপিএম সূত্র বলছে, এই ফাটল জোড়া লাগা কঠিন। অতীতের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কে বিভ্রান্তির পাশাপাশি আলিমুদ্দিনের মতবিরোধ এখন ছাপ ফেলছে রোজকার রাজনীতিতেও। শ্যামল সেন কমিশন উঠে যাওয়াকে প্রথমে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বলে অভিহিত করেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। বামফ্রন্টে আলোচনা করে বিমান বসু হঠাৎই কমিশন উঠে যাওয়া নিয়ে জবাবদিহি চেয়ে বসেন! বীরভূমের পাড়ুইয়ে বামেদের প্রতিনিধিদল যাবে কি যাবে না, তা নিয়েও প্রথমে দুই শিবিরে দু’রকম মত তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত রাশ হাতে নিয়েছে বাম পরিষদীয় দল। ঘটনা ঘটলে যেখানে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দরকার, সেখানে সিপিএম নেতৃত্বের বিভ্রান্তিকর অবস্থান ক্ষোভ ছড়িয়েছে নিচু তলাতেও।
ঘটনা এমন নয় যে, শুধু ১৯৭৮ সালের জালন্ধরের পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল, সেই বিতর্কে আলিমুদ্দিন দ্বিধাবিভক্ত। অদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বিজেপি-তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিএম কী ভাবে লড়বে, তা নিয়েও যে আলিমুদ্দিনের অন্দরে দু’টি মত, তার ইঙ্গিতও রয়েছে যথেষ্ট। দলের একাংশ চায়, বিজেপি-তৃণমূলকে রুখতে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তুলতে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেবেরা এই মতের শরিক। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ইয়েচুরির সুরে সুর মিলিয়ে শ্যামল চক্রবর্তীও সেই কথাই বলেছেন। নির্বাচনী বোঝাপড়া না হলেও অন্তত এক মঞ্চ থেকে আন্দোলন হোক। পলিটব্যুরোর সদস্য সূর্যবাবুও চান, একেবারে নিচু তলা থেকে বিজেপি-র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঝাণ্ডা ছেড়ে আন্দোলন হোক। আর এক দল চান শুধুই বাম গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকতে। রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু ছিলেন সেই মতের শরিক। কারাটের মতো তিনিও চেয়েছেন, চার বাম দলের বাইরে অন্য বাম দলগুলির সঙ্গে মিলে শক্তিশালী জোট গড়ে তুলতে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে মদন ঘোষ, দীপক দাশগুপ্তরা সেই সুরে কথা বলেছেন। যদিও আলিমুদ্দিন সূত্রের ইঙ্গিত, কেন্দ্রীয় কমিটিতে হাওয়া বুঝে কারাট না ইয়েচুরি, দোলাচলে পড়েছেন বিমানবাবুও।
অতীতের কাসুন্দি ঘাঁটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কলকাতার এক তরুণ কমিউনিস্ট নেতার মন্তব্য, “আমার জন্ম ১৯৭৮ সালের পরে। পার্টিতে নাম লিখিয়েছি নব্বইয়ের দশকের শেষে। আমার জন্মের আগে নেওয়া সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল ছিল, তা জেনে আমি কী করব?” এই তরুণ তুর্কির যুক্তি, “নেতাদের উচিত পশ্চিমবঙ্গে পার্টিটা ক্রমশ জুরাসিক পার্কে ঢুকে পড়ছে কেন, তার ময়নাতদন্ত করা!”
কারাট আশ্বাস দিয়েছেন, ময়নাতদন্ত হবে। পার্টি কংগ্রেসের পরে সাংগঠনিক সমস্যা নিয়ে প্লেনাম হবে। প্লেনাম ডাকার প্রধান কারণই হল, পশ্চিমবঙ্গে দলের সংগঠনের এই হাল কেন হল, তার কারণ খোঁজা। অনেক দেরি হয়ে গেল না? কারাট মানছেন, দেরি হয়েছে। কারণ পার্টির শক্তি কেন বাড়ছে না, তার কারণ খোঁজার সিদ্ধান্ত হয় ১৯৯৬-এ। যে বছর নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংহের উদার নীতির বিরুদ্ধে গলা ফাটান বামেরা। কিন্তু ভোটে লাভ কুড়িয়েছিল বিজেপি। তবে বিজেপি-কে আটকে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন, প্রয়াত জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার প্রস্তাব---এ সবের আনন্দে আর সেই ময়নাতদন্ত হয়নি। ইউপিএ-১ সরকারের আমলে বামেরা যখন লোকসভায় গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, তখনও সেই কথা মনে আসেনি। এ বার যখন দিল্লির সংসদে বামেদের মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে, তখন ফের ময়নাতদন্তের কথা মনে এসেছে!
এই ময়নাতদন্তে কি পশ্চিমবঙ্গে বাম দুর্গে ধসের কারণ উদ্ধার হবে? পলিটব্যুরোর এক নেতা বলেন, “১৯৭৮-এ পলিটব্যুরোয় যে ১১ জন ছিলেন, সেই ই এম এস, বাসবপুন্নাইয়া, সুন্দরাইয়া, সুরজিৎ, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তদের কেউই তো বেঁচে নেই। তাঁদের সিদ্ধান্তর ঠিক-ভুল বিচার না করে বুদ্ধদেব-বিমানদের কোথায় সমস্যা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখাটা অনেক বাস্তবসম্পন্ন।”