গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
যেমন নাটকীয় ভাবে শপথ নিয়েছিলেন, তার চেয়েও নাটকীয় দেবেন্দ্র ফডনবীসের বিদায়। যার জোরে সরকার গড়েছিলেন, সমর্থনের হাত সরিয়ে নিলেন সেই অজিত পওয়ারই। নিজেও ইস্তফা দিলেন অজিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আস্থাভোটে আর সংখ্যা জোগাড় করতে পারবেন না বুঝে ময়দান ছাড়লেন ফডনবীসও। প্রথমে সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করলেন। তার পর রাজভবনে গিয়ে দিয়ে এলেন পদত্যাগপত্র। সাড়ে তিন দিনেরও কম সময়ের মধ্যেই পতন ঘটল মহারাষ্ট্রে বিজেপি-‘এনসিপি’ সরকারের। ফডণবীস দুষলেন শিবসেনাকে। উল্লেখ করলেন অজিতের ইস্তফার জেরে প্রয়োজনীয় সংখ্যা না থাকার কথাও।
ফডণবীসের ইস্তফার পরেই প্রতিপক্ষ শিবিরে তোড়জোড় শুরু হয় সরকার গঠনের। শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরেকে নেতা করে সরকার গঠনের চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরিতে ব্যস্ত শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোট। মঙ্গলবার রাতে শরদ পওয়ার জানিয়েছেন, উদ্ধব ঠাকরে মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন। উপমুখ্যমন্ত্রী পাচ্ছে এনসিপি এবং কংগ্রেস। অর্থাৎ দু’জন উপমুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন। শপথগ্রহণ ১ ডিসেম্বর।
অথচ মঙ্গলবার দিনের শুরুটা এতটা খারাপ ছিল না বিজেপির জন্য। অন্তত বাইরে তো নয়ই। সুপ্রিম কোর্টের রায় কী হবে, তা নিয়ে চাপা উৎকণ্ঠা থাকলেও সংখ্যা নিয়ে এতটা দুঃশ্চিন্তা ছিল না বিজেপি শিবিরে। অজিত পওয়ার শেষ পর্যন্ত সংখ্যা জোগাড় করে দেবেন এমন আশা ছিলই। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট আগামিকাল বুধবার আস্থা ভোটে ফডণবীস সরকারকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের নির্দেশ দিতেই শুরু হয় তোলপাড়।
শীর্ষ আদালতের তিন বিচারপতির বেঞ্চ এ দিন নির্দেশ দেয়, দ্রুত প্রোটেম স্পিকার নির্বাচন করতে হবে। প্রোটেম স্পিকার বিধায়কদের শপথবাক্য পাঠ করাবেন। তার পর বুধবারের মধ্যেই আস্থা ভোট প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে হবে। এই রায়ের পরেই কার্যত অশনিসঙ্কেত শুরু হয় বিজেপি শিবিরে। কারণ, সোমবারই বিরোধী শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস শিবির তাদের ১৬২ জন বিধায়ককে এক জায়গায় এনে ফোটোসেশন করেছিল। ফলে বিজেপির সঙ্গে যে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যা নেই, এটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল। তবু একমাত্র আশা ছিল সময়। আরও কয়েক দিন হাতে পেলে সরকার গড়ে ফেলতে পারবে বলে আশাবাদী ছিল পদ্ম শিবির। কিন্তু সেই সময়টাই দেয়নি আদালত।
আরও পড়ুন: দীর্ঘ টানাপড়েন, বিদায় নিলেন ফডণবীস, মহা-নাট্যমঞ্চে নতুন নায়ক উদ্ধব ঠাকরে
রায়ের পর বলিউডি সিনেমার চিত্রনাট্যের মতোই মুহুর্মুহু পাল্টাতে থাকে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক চিত্র। সংখ্যা জোগাড়ে বিজেপি শিবিরে শুরু হয় তোলপাড়। নিজের বাসভবনেই দলের কোর কমিটির জরুরি বৈঠক ডাকেন ফডণবীস। সেখানে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে আস্থা ভোটের কৌশল নিয়ে প্রাথমিক আলোচনাও হয়। ওই সময়েই ফডণবীসের বাড়িতে যান অজিত পওয়ারও। তবে কিছু ক্ষণের মধ্যেই তিনি ফিরে আসেন।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আস্থা ভোটে কী হতে পারে, বিজেপি গরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারবে কি না, কাকে প্রোটেম স্পিকার নির্বাচিত করবেন রাজ্যপাল— এ সব নিয়ে যখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে সংবাদ মাধ্যমে, তখনই প্রথম ধাক্কা। রায়ের পর সবচেয়ে বড় খবর এল অজিত পওয়ারের দিক থেকে। উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিলেন অজিত। সেই অজিত, যিনি রাতারাতি শিবির বদলে শনিবার ভিড়ে গিয়েছিলেন বিজেপি শিবিরে। সেই অজিত, যিনি রবিবারও টুইট করে মোদী-অমিত শাহকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। আবার বিজেপি-এনসিপি জোটই সরকার গঠন করবে বলে টুইট করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘শরদ পওয়ারই আমাদের নেতা’।
রাজনৈতিক মহলের একাংশ অবশ্য তখনই আঁচ করেছিলেন কিছুটা। অনেকেই বলছিলেন, অজিত আসলে হাওয়ায় এই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জল মাপতে চাইছিলেন। সংখ্যায় কম হলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ওই অংশের জল্পনা এ দিন সত্যি হল। ওই টুইটের পরেই খোদ এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পওয়ার বলেন, ‘‘বিজেপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই।’’ অনেকেরই মতে, এর পর থেকেই গোপনে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেন অজিত। প্রস্তুতি শুরু করেন ঘরে ফেরার।
আর মঙ্গলবার শীর্ষ আদালতের রায়ের পর থেকেই অজিতের ইস্তফার জল্পনা ছড়িয়েছিল। এনসিপি শিবির থেকে আবার ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ‘অজিতকে ক্ষমা করে দিয়েছে দল’। তার পরে শরদ পওয়ার বৈঠক করেন ভাইপো অজিতের সঙ্গে। আর তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই অজিতের ঘোষণা এবং মুখ্যমন্ত্রী ফডণবীসকে পাঠিয়ে দেন পদত্যাগপত্র।
আরও পড়ুন: খোঁচালেই বিপদ, বুঝিয়ে দিলেন স্ট্রংম্যান থেকে কামব্যাক ম্যান হয়ে ওঠা শরদ পওয়ার
পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে রণকৌশল ঠিক করতে কার্যত হিমশিম খায় বিজেপি। দিল্লিতে জরুরি বৈঠকে বসেন নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ। ওই বৈঠকের পরেই দেবেন্দ্র ফডণবীস বিকেল সাড়ে তিনটেয় সাংবাদিক বৈঠক করবেন বলে ঘোষণা করেন। তখনই রাজনৈতিক মহলে জোর গুঞ্জন শুরু হয়, তবে কি কর্নাটকের পথেই এগোচ্ছে মহারাষ্ট্র। অর্থাৎ মহারাষ্ট্রে যে ভাবে আদালতের নির্দেশে আস্থাভোটে যাওয়ার আগেই ইস্তফা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নেওয়া বি এস ইয়েদুরাপ্পা, ফডণবীসও কি সেই পথেই হাঁটবেন? জল্পনা সত্যি করে ওই সাংবাদিক বৈঠকেই ইস্তফার ঘোষণা করেন ফডণবীস।
প্রথম পর্বে সরকার গঠন করতে না পারার দায় ফডণবীস ঠেললেন শিবসেনার উপর। আর দ্বিতীয় পর্বে সরকার টিকিয়ে রাখতে না পারার জন্য বললেন, সংখ্যার অভাবের কথা। ফডণবীস বলেন, ‘‘অজিত পওয়ার ইস্তফা দেওয়ায় আমাদের হাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যা নেই। তাই আমি ইস্তফা দিচ্ছি। আমরা দায়িত্বশীল বিরোধীর আসনেই থাকব।’’ ঘোষণা মতোই কিছু ক্ষণ পরেই রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ারীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে আসেন ফডণবীস। ফলে শেষ হয় মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন নাটকের দ্বিতীয় পর্ব।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
আর এখান থেকেই শুরু হচ্ছে মহা-নাটকের তৃতীয় পর্ব। গত শুক্রবারই শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস সরকার গঠনের সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। শনিবার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই শপথ নিয়ে ফেলেন ফডণবীস-অজিত জুটি। ফলে তিন দলের জোট ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ মোর্চা’র সরকার গঠনের প্রচেষ্টা চলে যায় পিছনের সারিতে। বড় হয়ে ওঠে সুপ্রিম কোর্টের লড়াই। সেই লড়াইয়ে জয়ই শুধু নয়, আস্থা ভোটের আগেই কার্যত পথের কাঁটা সাফ। ফলে সেই অনুযায়ী এগোতে শুরু করেছে তিন দল।
আস্থা ভোট না হলেও নতুন সরকার গঠন না হওয়ার পর্যন্ত সাংবিধানিক প্রক্রিয়া চালানোর জন্য প্রথমতো বিজেপি বিধায়ক কালিদাস কোলম্বকরকে প্রোটেম স্পিকার নির্বাচিত করেছেন রাজ্যপাল। আগামিকাল বুধবার তিনিই বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে বিধায়কদের শপথবাক্য পাঠ করাবেন। নতুন জোটের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পরেই এই নাটকের তৃতীয় তথা শেষ অঙ্কের যবনিকা পড়বে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
মহারাষ্ট্রের দ্বিতীয় পর্বের নাটকের সূত্রপাত ফডণবীস-অজিত শপথ নেওয়ার পর থেকে। শুক্রবার সন্ধ্যায় সরকার গঠন নিশ্চিত করে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গিয়েছিলেন যে তিন দলের নেতারা, তাঁরাই ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন হয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয় তিন দলের জোট। সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ‘অবৈধ’ দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে জরুরি ভিত্তিতে শুনানির আর্জি জানান তাঁরা। মামলা গ্রহণ করে রবিবার ছুটির দিনেও আদালতে চলে শুনানি। বিজেপিকে সরকার গঠনের আর্জি জানিয়ে রাজ্যপালের চিঠি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবি করে সরকার গঠনের আর্জি জানানো ফডণবীসের চিঠি জমা দিতে বলে আদালতের তিন বিচারপতির বেঞ্চ। পরের দিন সোমবার সকাল সাড়ে দশটায় ফের শুরু হয় শুনানি। গতকাল শুনানির পর আজ মঙ্গলবার রায়ের দিন নির্ধারিত করেন বিচারপতি। সেই মতোই রায় দেয় তিন বিচারপতির বেঞ্চ।
তার আগেই অবশ্য প্রথম পর্বের সূত্রপাত হয়েছিল ২৪ অক্টোবর ভোটের ফল ঘোষণার দিন থেকেই। আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ে এবং বিজেপি-শিবসেনা জোটের হাতে সরকার গঠনের মতো সংখ্যা থাকলেও দুই শরিকের মধ্যে শুরু হয় প্রবল সংঘাত। ৫০:৫০ ফর্মুলায় অর্থাৎ আড়াই বছর করে দু’দলের মুখ্যমন্ত্রীর সূত্রে বিজেপি রাজি না হওয়ায় সরকার গঠনই ভেস্তে যায়। শেষ পর্যন্ত তিক্ততা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে শিবসেনার একমাত্র মন্ত্রীও ইস্তফা দেন। এনডিএ থেকেও বেরিয়ে আসে উদ্ধব ঠাকরের দল।
ফল ঘোষণার প্রায় দু’সপ্তাহ পরে ৮ নভেম্বর বৄহত্তম দল হিসেবে বিজেপিকে সরকার গঠনের আহ্বান জানান রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ারী। সময় দেন ৭২ ঘণ্টা অর্থাৎ তিন দিন। কিন্তু বিজেপি সরকার গঠনের দাবিই জানায়নি। এর পর ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় দ্বিতীয় বৄহত্তম দল হিসেবে শিবসেনাকে সরকার গঠনের জন্য ডাকেন রাজ্যপাল। তাদের সময় বরাদ্দ হয় ২৪ ঘণ্টা। সরকার গঠনে এনসিপি এবং কংগ্রেস নীতিগত সায় দিলেও সমর্থনের চিঠি দেয়নি। তাই ভেস্তে যায় শিবসেনার প্রচেষ্টা। পরের দিন ১১ নভেম্বর তৄতীয় বৄহত্তম দল হিসেবে সরকার গঠনের জন্য এনসিপিকে ডাকেন রাজ্যপাল। কিন্তু এত অল্প সময়ে সরকার গঠন সম্ভব নয় ১২ নভেম্বর জানিয়ে দিলেন এনসিপি নেতৄত্ব।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
অন্তিম বিকল্প রাষ্ট্রপতি শাসন। কেন্দ্রকে সেই সুপারিশই করলেন রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ারী। ব্রাজিল সফর বিলম্বিত করে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হল, সরকার গঠনের পথ খোলা রেখে ৬ মাসের জন্য রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশপত্রে সিলমোহর দিয়ে ব্রাজিল উড়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। ৩৫৬ ধারায় সই করলেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। মহারাষ্ট্রে কার্যকরী হল রাষ্ট্রপতি শাসন।
এর পর ১২ তারিখ থেকে টানা আলোচনা, বৈঠকের পর বৈঠক করে যখন সরকার গঠন প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছিল শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস তখনই আচমকা শনিবার ঘুম থেকে উঠে সবাই দেখল, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নিয়ে ফেলেছেন দেবেন্দ্র ফডণবীস। এনসিপি থেকে বেরিয়ে অজিত পওয়ার সমর্থন করেছেন বিজেপিকে। এনসিপির ‘পরিষদীয় দলনেতা’ হিসেবে দিয়েছেন সমর্থনের চিঠিও। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে আদালতের দ্বারস্থ হয় বিরোধী জোট।