জমতাড়ায় তৈরি হওয়া নতুন সাইবার থানা। সাইবার অপরাধ দমনে এই থানাই মূল ভরসা ঝাড়খণ্ড পুলিশের। নিজস্ব চিত্র
জানলার কাছে চেয়ার পেতে কিছু লিখে চলেছেন এক অফিসার। ঘামছেন দর দর করে। আশপাশে মশার ঝাঁক। উল্টো দিকের টেবিলে পর পর তিনটি ডেস্কটপ কম্পিউটার বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। তারই একটির সামনে এত ক্ষণ বসে থাকা ব্যক্তি উঠে পড়ার আগে বললেন, ‘‘এই নিয়ে সাত বার হল, স্যর। একটা চার্জশিট লিখতে পারছি না!’’ অফিসার মশা মারার জন্য হাত ছুড়লেন।
জামতাড়ায় তৈরি হয়েছে নতুন সাইবার থানা। এক তলা বাড়ির সাদা রং করা দেওয়াল, নীল বর্ডার। মূল গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে এক দিকের দেওয়ালে সাইবার অপরাধে অভিযুক্তের অধিকার, আর এক দেওয়ালে পুলিশের অধিকার লেখা পোস্টার। সে সব পড়তে পড়তেই বিদ্যুৎ গায়েব। জানা গেল, সে দিনই যেমন সকাল থেকে সাত বার বিদ্যুৎ সংযোগ চলে গিয়েছে।
এমন অবস্থা কেন? ঘাড় গুঁজে লিখে যাওয়া অফিসার মুখ তুলে চেয়ার টেনে বসতে বললেন। রাঁচী থেকে সাইবার থানার দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে তাঁকে। নাম দেবেন্দ্রকুমার বর্মা। বললেন, ‘‘পাখার তলায় বসে লাভ কী? কখন চলবে, তার তো ঠিক নেই। জানলার কাছে বসলে আলোয় দেখে লেখা যায়, হাওয়াও আসে। কিন্তু এই ভাবে ক’দিন চলবে জানি না। বিদ্যুৎ থাকে না। কম্পিউটার আটকে যায়। ইন্টারনেট সংযোগ উড়ে যায়। এই নিয়ে সাইবার অপরাধী ধরতে নেমেছি আমরা!’’
গোটা দেশের গোয়েন্দাদের নিত্য যাতায়াত জামতাড়ায়। প্রতি দিন গড়ে দু’শোটিরও বেশি অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত শাখা থেকে আসে ঝাড়খণ্ড পুলিশের কাছে। আন্তর্জাতিক তদন্তকারী সংস্থার পাশাপাশি আমেরিকার গোয়েন্দারাও মাসে অন্তত এক বার করে এই তল্লাটে ঘুরে যাচ্ছেন বলে খবর। এই নানা চাপের মুখে জামতাড়ায় সাইবার থানা তৈরি হয়। দেবেন্দ্র জানালেন, এই রাজ্যের বাকি থানায় এক জন অফিসারের নেতৃত্বে কাজ চলে। কিন্তু সাইবার থানায় একাধিক অফিসার থাকতে পারেন। জামতাড়া সাইবার থানায় যেমন রাঁচী থেকে দেবেন্দ্র-সহ পাঠানো হয়েছে পাঁচ জন অফিসারকে। তৈরি করা হয়েছে পুলিশের ‘কুইক রেসপন্স’ দল। কিন্তু এর পরেও সাইবার থানারই যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে বাকি থানার পরিস্থিতি কী?
সাইবার অপরাধ মানচিত্রে উপরের দিকে থাকা কর্মাটাঁড় ব্লকের কর্মাটাঁড় থানায় পৌঁছে দেখা গেল, ল্যান্ডলাইন বিকল দীর্ঘদিন। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন টানা দু’দিন। থানা-প্রভারী (স্টেশন হেড অফিসার বা এসএইচও) বললেন, ‘‘থানার পুরনো ভবনে সৌর প্যানেল লাগানো ছিল। বিদ্যুৎ সংযোগের সমস্যা ছিল না। নতুন ভবনে আসার পর থেকেই কাজ করা যাচ্ছে না।’’ এর পর তাঁর দাবি, ‘‘সাইবার অপরাধীদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। সাইবার থানা নিজের মতো করে হানা দেয়। আমাদের জানানোও হয় না। কোথাও হানা দিতে যাওয়া পুলিশকর্মীকে সাইবার দস্যুরা তুলে নিয়ে গেলে আমাদের ডাক পড়ে।’’
একই অবস্থা জামতাড়ার এই অংশের নারায়ণপুর থানারও। সেখানকার এক পুলিশকর্মীর দাবি, ‘‘এখানে বিনোদন বলতে তো শুধুই মোবাইল ফোন। মোবাইল হাতে বসেই কেউ একটা প্রথম এই নতুন ধরনের প্রতারণার ফাঁদ বার করেছিল। কিন্তু নতুন নতুন এত ধরনের প্রতারণা হয়, যে আমরা আর মাথাই ঘামাই না।’’ নালা থানার প্রভারী (এসএইচও) বললেন, ‘‘গ্রামের পর গ্রাম প্রতারণার কাজে যুক্ত। হাতেগোনা পুলিশ নিয়ে কত জনকে ধরব? বড় কিছু ঘটলে বাইরের পুলিশ এসে যা করার করে।’’
তার মানে বড় মাপের টাকা হাতানোর ব্যাপার না ঘটলে সে ভাবে দেখাই হয় না? জামতাড়ার থানা-প্রভারী রাজেশ মণ্ডলের দাবি, কেউ প্রতারিত হলে স্থানীয় থানার পাশাপাশি ১৯৩০ (জাতীয় সাইবার প্রতারণা সংক্রান্ত হেল্পলাইন) নম্বরে ফোন করে অভিযোগ জানাতে বলা হয়। কোন নম্বর থেকে ফোন এসেছিল, সেটা ধরে তদন্ত শুরু হয়। প্রায় ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রতারক ভুয়ো নথির মাধ্যমে চালু হওয়া সিমকার্ড থেকে প্রতারণার ফাঁদ পাতায়, ওই নম্বর ধরে এগোনো সম্ভবই নয়। তদন্ত তা হলে এমন লোকের কাছে পৌঁছবে যিনি হয়তো জানেনই না যে তাঁর নামে ফোন নম্বরটি চালু রয়েছে।
এই সমস্যা মেটাতে সম্প্রতি ঝাড়খণ্ড পুলিশ ‘প্রতিবিম্ব’ নামে একটি অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছে। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে যুক্ত হয় এই অ্যাপ্লিকেশন। নম্বর চালু থাকলেই কোথায় সেটি রয়েছে, তার ‘লাইভ লোকেশন’ দেখিয়ে দেয় ‘প্রতিবিম্ব’। কিন্তু সমস্যা হল, কার্যোদ্ধারের পরে সিমকার্ড খুলে ফেললে কোনও ভাবেই তার অবস্থান ধরা পড়বে না অ্যাপে। একসঙ্গে প্রচুর সিমকার্ড ব্যবহার করায় এক নম্বর থেকে বেশি ফোন প্রতারকেরা করে না। তবে পুলিশের দাবি, প্রতি দিন যে হেতু কয়েকশো অভিযোগ আসে তাঁদের কাছে, কয়েকশো ফোন নম্বরও আসে। সমস্ত নম্বর তালিকায় রেখে অ্যাপের মাধ্যমে খোঁজা হয়। কোনও একটির অবস্থান ধরে প্রতারককে গ্রেফতার করা গেলে উদ্ধার হয় আরও অনেক সিমকার্ড এবং মোবাইল ফোন। অ্যাপের মাধ্যমে উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর ধরে খোঁজ করলেই আবার পাওয়া যায় সংশ্লিষ্ট ফোনে কত গুলো সিমকার্ড ব্যবহার হয়েছে। রাজেশের কথায়, ‘‘এর পরেও সমস্যা হচ্ছে, যে ফোন উদ্ধার হল, তা থেকেই ফোন করা হয়েছে এবং যাঁর কাছ থেকে উদ্ধার হল, তিনিই ফোনটা করেছেন এটা প্রমাণ করতে হয়। না হলে মামলা দাঁড়ায় না।’’
আরও একাধিক কারণে এই ধরনের মামলা দাঁড়ায় না বলে দাবি পুলিশের। ধরা যাক, মহারাষ্ট্র বা তামিলনাড়ুর কেউ প্রতারিত হয়েছেন। হয়তো তিনি তদন্তে সাহায্যে করার জন্য এক বার জামতাড়ায় এলেন। কিন্তু আদালতে মামলা ওঠার পরে আর এলেন না। রাজেশের মন্তব্য, ‘‘সে ক্ষেত্রে মামলা দুর্বল হয়ে অভিযুক্ত জামিন পেয়ে যাবে। জামিন পেয়ে ফের শুরু করবে লোক ঠকানোর কাজ।’’
জামতাড়া পুলিশের সুপার অনিমেষ নৈথানির যদিও দাবি, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই প্রতারিত হলে তার পর অভিযোগ আসে। আমরা বলছি, এমন ফোন পেলেই ১৯৩০ নম্বরে অভিযোগ করুন। কারণ, প্রতারক প্রচুর নম্বর একসঙ্গে ব্যবহার করে। টাকা হাতানো হয়ে গেলে সিম কার্ড খুলে ফেলে দেয়। কিন্তু যে নম্বর থেকে টাকা হাতানো হয়নি, সেটি পরেও ব্যবহার করে। ফোন পেয়েই অভিযোগ করা হলে নম্বরটাও আমরা পেয়ে যাব। তাতে টাকা হাতানো যায়নি ভেবে যে সিমকার্ড চালু রাখা হয়েছে সেটা দিয়েই প্রতারকের কাছে পৌঁছনো যাবে।”
অনিমেষের দাবি, জামতাড়া এখন আগের তুলনায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। বরং প্রতারণার নতুন ‘হট-স্পট’ তৈরি হচ্ছে দেওঘর, গিরিডি-র মতো জায়গা ঘিরে।
এ যেন রক্তবীজ। এর শেষ নেই!