মোদীর দয়ায় এক লাইনে কাজের লোক আর মালকিন

ও ব্যাঙ্ক গো আমার না পেয়ে তোমার দেখা, পকেট ফাঁকা, দিন যে আমার কাটে না রে!’ মধ্যবিত্তরা আজকাল মাঝেমধ্যেই এই গানটি গেয়ে উঠছেন। আর উচ্চবিত্তরা গাইছেন—‘নোটগুলি মোর হাজার টাকার, রইলো না, রইলো না-আ-আ-আ!’ এরকমই একটা নয়, দুটো নয়—প্রায় শ’খানেক গান ফেসবুক ও হোয়াট্‌স্‌-অ্যাপে চলছে।

Advertisement

সায়ন্তনী পূততুন্ড

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩৪
Share:

‘ভেঙে মোর হাজার টাকা, দিয়ে যা না চেঞ্জ আমারে

ও ব্যাঙ্ক গো আমার না পেয়ে তোমার দেখা, পকেট ফাঁকা, দিন যে আমার কাটে না রে!’

Advertisement

মধ্যবিত্তরা আজকাল মাঝেমধ্যেই এই গানটি গেয়ে উঠছেন। আর উচ্চবিত্তরা গাইছেন—‘নোটগুলি মোর হাজার টাকার, রইলো না, রইলো না-আ-আ-আ!’ এরকমই একটা নয়, দুটো নয়—প্রায় শ’খানেক গান ফেসবুক ও হোয়াট্‌স্‌-অ্যাপে চলছে। রবি ঠাকুর তো চিরকালই হিট ছিলেন। আর উপরি পাওনা নোটের কারিকুরি ও ব্যাঙ্কের জারিজুরি। এখনও শীত তেমন ভাবে পড়েনি। কিন্তু আসমুদ্র হিমাচল হি হি করে কাঁপছে! কারণ? নোট পাওয়া যাচ্ছে না! হঠাৎ ‘কী করিয়া কী হইয়া গেল’—একরাতের মধ্যে পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট অচল হয়ে গেল। মোদী সরকার, পি সি সরকার হয়ে নোটগুলোকে ভ্যানিশ করে দিলেন। পড়ে রইল গাধীঁজির ছবি আঁকা রাশি রাশি কাগজ—আর হাতে রইল পেন্সিল!

আমি নিজে চিরকালই একটু ভোঁদড় মার্কা মানুষ। এক কথায় যাকে বলে ম্যান্তামারা! নোট বদল হয়ে কালো টাকা সাদা হল কিনা তাতে আমার মস্ত এসে যায়! রাজনীতি ও অর্থনীতি বোঝার চেয়ে রাবণকে স্যান্ডোগেঞ্জি পরানো আমার কাছে সহজ। তার চেয়ে বাপু শান্তিতে দুটো ডাল-ভাত খেয়ে দিব্যি চোখ বুজে কাটিয়ে দিলেই হল। শার্দুল শাবকেরাই বরং হরতাল করুক! গলা ফাটিয়ে চেঁচাক ওরা। ওদের তর্জনে গর্জনে যেন মোদীজির গদি নড়ে ওঠে। ওদের দন্ত-নখরে শান দেওয়া দেখে সরকারের যেন রাতের ঘুম উড়ে যায়! ওরা পথে নামুক। প্রতিবাদ করুক। অনশন করুক। আমি বৃথা ভেবে মরি কেন? ভোঁদড়ের কি বাঘ হওয়া সাজে? এর চেয়ে বেঁচে থাক আমার ডাল-ভাত আর নিশ্চিন্ত জীবন। কিন্তু মুশকিল হল, সেটাও যে জুটছে না! সে দিন রাতে খবরটা শোনার পর রীতিমতো আশঙ্কা হয়েছিল যে পরদিন বাজার বসবে কি না। আর যদি বসেও তাহলে কি পাঁচশো টাকার নোট নেবে কেউ? বাবার পেনশনের সমস্তটাই তো ব্যাঙ্ক পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটে দিয়ে বসে আছে। তবে? শেষ পর্যন্ত কি ডাল ভাতটুকুও জুটবে না! রীতিমতো আতঙ্কিত ও আশঙ্কিত হয়ে সে রাত্রে ঘুমোতে গেলাম। স্বপ্নে দেখলাম বাজারের বিখ্যাত মাছবিক্রেতা হুলোকাকু একটা বিরাট আঁশবটি নিয়ে বাবাকে তাড়া করেছে। আর চতুর্দিক দিয়ে শিল্পপতিরা থলে হাতে নিয়ে বাবার পিছন পিছন দৌড়চ্ছে আর বলছে—‘হাজার নেবেন হাজার? পাঁচশো নেবেন, পাঁচশো?’

Advertisement

সৌভাগ্যবশতঃ তেমন কিছু হয়নি। আঁশবটির হাত থেকে বেঁচে গেলেও সে দিন বাবার বাজারটা মাটি হল। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে বাবা অত্যন্ত শৌখিন। আমিও কিছু কম যাই না। কিন্তু সে দিন বাবা বাজার থেকে ফিরল মুখ চুন করে! পাঁচশো টাকার নোট ভাঙাতে কেউ রাজি নয়! হুলোকাকু স্পষ্ট বলে দিয়েছে, চারশো টাকার মাছ কিনলে তবেই ঐ অলুক্ষুণে নোট নেবে। কিন্তু সংসারের তিনটে প্রাণীর জন্য অত টাকার মাছ কিনে কী করবে? কাঁহাতক ফ্রিজে রেখে খাওয়া যায়? অগত্যা সেদিন আর বাজার করা হল না। বাবা, মা ও আমি--এই তিনটে মানুষের পুঁজি ঘেঁটেঘুঁটে তিনটে মাত্র একশো টাকার নোট আর যৎসামান্য খুচরো টাকা পাওয়া গেল। তাই দিয়ে মুদির দোকান থেকে গোটা কয়েক ডিম, আর টুকিটাকি জিনিস কিনে আনা হল। অন্তত সেদিনের মত তো পিত্তি রক্ষা হল! কিন্তু এবার কী হবে? শুধু খাওয়া নয়, অন্যান্য খরচও আছে। ডাক্তার-ওষুধের খরচ, মাসের মাল, ঘরের কাজের মেয়েদের মাইনে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সবের কী হবে?

অগত্যা আমার ষাটোর্ধ্ব বাবা চললেন ব্যাঙ্ক অভিমুখে। সঙ্গে ভোঁদড়ের মত গুটিগুটি পায়ে আমি। ব্যাঙ্কে তখন হুলুস্থূলু কান্ড চলছে! মানুষের ভিড় দেখে মনে হয়, ওটা ব্যাঙ্ক নয়, কোনও স্টেডিয়াম! এবং সেখানে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের ম্যাচ চলছে। ভিতরে মানুষ, বাইরে মানুষ। শ’খানেক উত্তেজিত মুন্ডু বিরক্ত হয়ে গজগজ করছে। এক এক জনের এক এক রকমের বিরক্তি! থেকে থেকে ‘ধুত্তোর’! ‘ইরিটেটিং’, ‘ধুস্‌’! এই সব শব্দবন্ধ ভেসে আসছে। আহা! কী দৃশ্য! এক রাতের মধ্যে জাত-পাত, অর্থনীতির ভেদাভেদ, স্টেটাস-অহঙ্কার থেকে বেরিয়ে এসেছে বাঙালি! বিড়িওয়ালার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মার্সিডিজধারী! ঠিকা কাজের মেয়ে, আর তার মালকিন এক সঙ্গে লাইনে! এমন দিন শেষ কবে দেখেছে ভারত! এ মিলন মহামিলন। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে।

ওদিকে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পায়ে দুব্বোঘাস গজানোর উপক্রম! মনে হচ্ছিল, হেরিটেজ হয়ে গিয়েছি। তার মধ্যেই এক ভদ্রমহিলা আমার ডান পায়ের ওপর প্ল্যাটফর্ম হিল চাপিয়ে বসে আছেন! ভাবলাম এক বার বলি—‘ডান পায়ে তো অনেক হল, এবার বাঁ পায়ে আসুন। শুনেছি নোটে এবার গাধীঁজি প্রোফাইল পাল্টেছেন! আপনিই বা বাকি থাকেন কেন?’ কিন্তু মহিলার ইস্পাতমুখ দেখে স্রেফ ভয়ে চেপে গেলাম। আর বলিহারি ব্যাঙ্কের কর্মচারীরাও! আমার চারটে পাঁচশো টাকার নোট ছিল। সেটা জমা দিতেই কাউন্টারের ভদ্রলোক এমন মুখ করে তাকালেন, যেন সারাদিন রাঘব বোয়ালের আশায় থেকে দিনের শেষে পুঁটিমাছ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন!

যাই হোক, অনেক ঝামেলা করে, জুতোর শুকতলা খইয়ে শেষ পর্যন্ত টাকা পাওয়া গেল! নতুন টাকা দেখে ভারি আমোদ হল। ছোটবেলায় অনেক বার ‘ব্যবসায়ী’ খেলেছি। নোটগুলো হুবহু ‘ব্যবসায়ী’র নোটের মত। আর কী রঙ! গোলাপি গোলাপি দু’হাজার টাকার নোটটা দেখে তো আহ্লাদে আটখানা! গোলাপি জামার সঙ্গে দিব্যি মানাবে! কী যেন ছাপ টাপ আছে শুনলাম! কিন্তু এ পোড়া চোখে ধরা পড়ল না। শুনলাম কীসব চিপ-টিপও বসানো আছে। চিপে গান ভরা গেলে বেশ হত। যখনই হস্তান্তর হত নোটটা, তখনই গান বাজত—‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি’। আর যাই হোক্‌, ব্যাটা চিনেরা এই গানটা নকল করতে পারত না।

কিন্তু এত কান্ড করেও শেষরক্ষা হবে কি? ব্যাঙ্কে টাকা অপ্রতুল! ম্যানেজারের মুখ দেখলে দুঃখ হয়। মনে হয়, যে সংসারে সব বাড়ন্ত সেই সংসারের গৃহিনী তিনি। ঠিক মতন টাকার জোগান নেই। স্বাভাবিক ভাবেই তাই এক এক দিন এক এক রকমের নিয়ম চালু হচ্ছে। কখনও বলা হচ্ছে ‘দশ হাজারের বেশি টাকা তোলা যাবে না’, কখনও বলা হচ্ছে ‘জিরো ব্যালেন্সের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হবে না’। সমস্ত উপায়ী মানুষ চিন্তায় পড়েছেন, তাদের স্যালারি, পেনশন—আদৌ পাওয়া যাবে কি না! পাওয়া গেলেও মোট উপার্জনের কতটা পাওয়া যাবে! ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। খেটে খাওয়া মানুষেরা অসহায়! ভাষণ শুনছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান নেই। কোনও কোনও শহরে নাকি টাকা ওড়ে! এতদিন শুধু শুনেছি। এখন দেখলাম সত্যিই ওড়ে। হেলিকপ্টারে চড়ে উড়ে উড়ে আসছে টাকা। কিন্তু তাও যথেষ্ট কি?

শার্দুল শাবকেরা ফেসবুকে বিপ্লব করছেন। কোথায় কোথায় কোন নেতা-নেত্রীর কাছে কালো টাকা আছে সে বিষয়ে তাদের সম্যক ধারণা দেখে অবাক হতে হয়। আই টি অফিসারেরা কেন যে এদের সঙ্গে মিটিং করেন না কে জানে! ফেসবুক, টুইটারে তর্ক জমে উঠেছে। মোদীজির পদক্ষেপ সঠিক না ভ্রান্ত—সেই নিয়েই আকচা আকচি। মোদীজির অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে—তাও তারা জেনে বসে আছেন! সেই নিয়ে ‘তুই বিড়াল না মুই বিড়াল’ চলছে। হুংকার দিয়ে বলছেন—‘এ অন্যায়! আমার টাকা ব্যাঙ্ককে দেব কেন? বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী!’ পরদিনই সুড়সুড় করে ব্যাঙ্কে গিয়ে নতুন নোট হাতে নিয়ে রীতিমত পোজ মেরে সেলফি তুলছেন। যেন ওটা নোট নয়, অলিম্পিকের মেডেল! ধুর্‌ ধুর্‌, এর চেয়ে ভোঁদড়ই ভালো।

এটা ঠিক যে জনতা সরকারের সঙ্গে যথেষ্ট সাহায্য করছে। ব্যাঙ্কগুলোও তাদের দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে জাগে। একটা নোটের আসল দাম সত্যি কি আমরা জানি? নাকি যে কৃষক ফলিডল খেয়ে মরল, যে ব্যবসায়ী আত্মঘাতী হলেন—তারা জানতেন! নোট বদলে কিছু কালো টাকা উড়ল, কিছু পুড়ল, কিছু ভিখিরির ভিক্ষাপাত্রে ফেলে দেওয়া হল। কিন্তু বেশির ভাগ কালো টাকা যে নানা সম্পত্তির পিছনে লুকিয়ে আছে তার হিসেব কে করবে? নোট বদলানো যায়—কিন্তু দেশ বদলানো কি এত সহজ?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement