গুজরাতে বনসকাঁঠা জেলার ডীসায় জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদী। শনিবার। ছবি: পিটিআই।
গোলপোস্টটাই পিছিয়ে দিলেন তিনি। এতটাই যে, সেটা নজরেই আসছে না আর!
গত ৮ নভেম্বর রাতে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, লড়াইটা পঞ্চাশ দিনের। তাতেই নিকেশ হবে যত জাল ও কালো টাকা। পথে বসবে সন্ত্রাসবাদী ও মাওবাদীরা। একটু দুর্ভোগ হলেও দেশবাসী যেন তাঁকে এই ক’টা দিন দেন। কিন্তু ওই ঘোষণার মাসপূর্তির দু’দিন পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কবুল করলেন, আদৌ পঞ্চাশ দিনে শেষ হওয়ার নয় মানুষের সমস্যা। সময় লাগবে আরও বেশি।
কত বেশি? আজ আর কোনও সময়সীমা ঘোষণার পথে হাঁটেননি প্রধানমন্ত্রী। শুধু জানিয়েছেন, পঞ্চাশ দিনের পর থেকে সমস্যা ধীরে ধীরে কমে আসবে। এবং মানুষ নিজের চোখেই সেটা দেখতে পারবেন।
সরকারে মোদীর সেনাপতি, অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও ক’দিন ধরে বলে আসছিলেন, নোট বাতিলে তৈরি হওয়া সমস্যা পঞ্চাশ দিনে মেটার নয়। গুজরাতে বনাসকাঁঠা জেলার ডীসায় এক জনসভায় মোদী আজ কার্যত সেটাই মেনে নিলেন। বিরোধীরা বলছেন, মোদী বলে রেখেছেন, নোট-বাতিলে দেশের ভাল না হলে পঞ্চাশ দিন পর চৌরাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবেন। দেশ যে শাস্তি দেবে তা-ই মাথা পেতে নেবেন। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝেই কি এক মাস পেরিয়ে এসে এখন আরও কিছুটা সময় চাইছেন তিনি?
নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পরে এই প্রথম নিজের রাজ্যে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। চেনা মাঠে জনতার সামনে থেকে তিনি আজ নিশানা করেন বিরোধীদের। গত কালই রাহুল গাঁধী অভিযোগ এনেছেন, সরকার তাঁকে লোকসভায় বলতে দিচ্ছে না। যদি সেই সুযোগ পেতেন, তা হলে ভূমিকম্প হতো। এ দিন মোদীর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘আমাকেই লোকসভায় বলতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই জনসভায় যা বলার বলছি।’’
দু’দিন আগেই বিজেপি বর্ষীয়ান নেতা সংসদে কাজকর্ম না চলার জন্য বিরোধীদের পাশাপাশি সরকার পক্ষ এমনকী, পরোক্ষে স্পিকার সুমিত্রা মহাজনকেও কাঠগড়ায় তুলেছেন। মোদী কিন্তু আজ বল ঠেলে দেন বিরোধীদের দিকেই। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সরকার সংসদে আলোচনায় রাজি। প্রধানমন্ত্রীও বলতে চান। কিন্তু বিরোধীরাই আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছে তাদের যুক্তি ধোপে টিকবে না বলে।’’ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সংসদ সচল রাখার আহ্বানের প্রসঙ্গে তুলে মোদী বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপতি দীর্ঘদিন দেশের শাসন ব্যবস্থা চালানোর কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি শ্রেষ্ঠতম। সংসদ না চলায় তিনিও এতটাই দুঃখিত যে সাংসদদের বার্তা দিতে বাধ্য হয়েছেন।’’
বিরোধীরা তবু প্রশ্ন তুলছেন, বারবার সরকারের অবস্থান বদল নিয়ে। এটা ঘটনা, শুধু সময়সীমা নয়, নোট বদল নিয়ে নিয়ম-কানুন ও সরকারের বয়ান কম বদলায়নি এই এক মাসে। বাতিল ৫০০-১০০০ টাকার নোট কোথায় কত দিন জমা করা যাবে, ক’দিনে কত টাকা তোলা যাবে— এ সব নিয়ে নিত্যনতুন এত রকম দাওয়াই দেওয়া হচ্ছে যে, তার খেই রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে আমজনতা। তার উপরে কাজকর্ম শিকেয় তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এটিএম-ব্যাঙ্কে লাইন দিয়েও হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে মানুষকে। মাঠের পাকা ধান গোলায় তোলা বা রবি চাষের জন্য বীজ-সার কেনারও টাকা নেই চাষির হাতে। এই দুর্ভোগ নিয়ে বিরোধীদের সুর যত চড়ছে, ততই সুর বদলাচ্ছে সরকারের। কালো টাকা, সন্ত্রাসবাদী, মাওবাদীদের প্রসঙ্গ পিছনে সারিতে পাঠিয়ে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা এখন সরব ডিজিটাল লেনদেন নিয়ে। নিজের রাজ্যে ওই জনসভায় মোদী আজ সেই ডিজিটাল লেনদেনের পক্ষেই জোর সওয়াল করেন। বিরোধীদের সমালোচনা করে বলেন, ‘‘ওঁরা মানুষের দুর্দশার কথা বলছেন, মানুষকে ওঁরা এটা কেন বলছেন না যে, ব্যাঙ্ক-এটিএমে লাইন দেওয়ার কোনও দরকারই নেই!’’
মোদী-জেটলিদের বয়ানে আরও একটি বদল লক্ষ্য করার মতো। বদলটা নিশানায়। আগে তাঁরা বলছিলেন, এটা সন্ত্রাসবাদ, জাল আর কালো টাকা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ। আমজনতার দুর্দশা চরমে ওঠার পরে মোদী এখন নোট বাতিলের সঙ্গে গরিবের স্বার্থ রক্ষার কথা জুড়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। গুজরাতের সভায় এ দিন তাঁর দাবি, ৫০০-১০০০ টাকার নোট বাতিলের পরে ১০০, ৫০, ২০ টাকার ‘শক্তি’ বেড়েছে। তাঁর কথায়,‘‘বড় নোট নয়, আমি ছোট নোটের শক্তি বাড়িয়েছি। বড়লোক নয়, গরিব মানুষের শক্তি বাড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, ৭০ বছর ধরে দেশের ‘ইমানদার’ নাগরিকদের লুটে নেওয়ার কাজ হয়েছে। অথচ তাঁদের জন্য তিনি যখন এত বড় পদক্ষেপ করলেন, তখন বিরোধীরা দেশের মানুষকে খেপিয়ে তুলতেই ব্যস্ত। মানুষ তাদের ফাঁদে পা দেবেন না বলেই মোদীর বিশ্বাস।
নোট-মন্বন্তরের এই এক মাসে বিপুল অঙ্কের কালো টাকা সাদা করে ফেলার বিভিন্ন ঘটনা সামনে এসেছে। দিল্লি থেকে চেন্নাই বিভিন্ন শহরে কিছু ব্যক্তির কাছে বিপুল অঙ্কের নতুন নোট মিলেছে। চলছে ধরপাকড় তল্লাশি। ধরা পড়েছেন বেশ কিছু ব্যাঙ্ক-কর্তাও। কিন্তু সব নিয়ে ইডি, সিবিআই, আয়কর কর্তারা তৎপর হতেই অন্য একটি উদ্বেগ জন্ম নিচ্ছে বিভিন্ন মহলে। অনেকে বলছেন, ‘ইন্সপেক্টর-রাজ’ তৈরি হচ্ছে দেশে। গরিব-দরদি ভাবমূর্তির টানে সেই উদ্বেগে বরং হাওয়াই জুগিয়েছেন মোদী। তাঁর কথায় ‘‘নভেম্বরের ৮ তারিখের পরে কেউ পাপ করে থাকলে, সে আর বাঁচবে না। ব্যাঙ্কের কর্মীরাও জেলে যাচ্ছেন। আমি পিছনের দরজাতেও ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছি।’’
নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে লাভ কী হবে, এটা নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। এর জবাব দিতে প্রধানমন্ত্রী আজ চার্বাক দর্শনের প্রসঙ্গ টানেন। মোদীর দাবি, ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ অর্থাৎ ধার করে হলেও ঘি খাও— এমন ভাবনা ভারতের মাটিতে কখনওই গুরুত্ব পায়নি। ভবিষ্যতের কথা ভেবেই যাবতীয় পদক্ষেপ করে এসেছেন সংসারের বয়স্করা। তিনিও ভারতের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ঋষি-বাক্য থেকে ডিজিটাল ভারতের স্বপ্ন— নোট-যুদ্ধে সব রকম হাতিয়ারই প্রয়োগ করছেন মোদী।
ফলের আশায়!