—প্রতীকী ছবি।
কাবুলি উজ়বেকি পুলাও আর ইয়াখনি গোস্ত-এর গন্ধে আমোদিত হয়ে রয়েছে দিল্লির এই আফগান-পাড়াটি। ছুটির দিন নয়, কিন্তু আজ ‘কাবুল দিল্লি রেস্তরাঁ’-য় দুপুর থেকেই বাড়তি ভিড়। টেবিল-চেয়ারের পাশাপাশি মজলিশে বসার মতো করে তাকিয়া আর গালিচা-পাতা খাওয়ার জায়গাও রয়েছে। মাঝে সাদা-সোনালি পুলাও, মাটন রান আর নান রেখে গোল হয়ে বসে নানা বয়সের আফগানি। লাজপত নগর সেন্ট্রাল মার্কেটের একটি অংশে।
কিন্তু আজ তাঁদের খাওয়ায় মন কম। সেটা নেহাত অনুপান মাত্র। চক্ষু স্থির— দেওয়ালে লাগানো স্ক্রিনে বিশ্বকাপের ম্যাচে হাশমতুল্লাহ শাহিদি, রহমতুল্লাহ গুরবাজ়, রশিদ খানদের দেখতে।
“আপনি উর্দু বোঝেন?” ভাঙা হিন্দিতে বললেন রহমতুল্লা আলি, চোখ টিভির দিকে রেখেই। কারণ ওঁদের পুস্তু ভাষার আড্ডা এবং হইচই কিছুই বোধগম্য না হওয়ায় হিন্দিতেই কথা বলতে হয়েছে। তাতেই এই উত্তর। “শুনুন তবে। ভারত-আফগান ভাই ভাই। ভারতের সঙ্গে খেলা থাকলে আমরা তাই বেশি টেনশনে ভুগি না। আফগানিস্তান আমাদের মাতৃভূমি হতে পারে, কিন্তু গত কয়েক বছর পেটে দানাপানি জোগাচ্ছে এই দিল্লি শহরই।’’ রহমতুল্লার ‘আফগান ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’ কয়েকশো মিটার দূরেই। ও দেশ থেকে বিমান আসা বন্ধ রয়েছে। তাই বিক্রি করছেন ভারতীয় পণ্যই। গত বারো বছর তিনি এই শহরেই। ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেন না। মাঝে তুমুল পালাবদল হয়ে তালিবান আসার পরে কী চলছে, সে খবর পান রিস্তেদারদের কাছ থেকে।
পাশের ‘মাজ়ার কাবাব শপ’-এ খেলা দেখা এবং দুপুরের খাওয়া সারতে এসেছেন একঝাঁক আফগানি যুবক। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন, সপ্তাহান্তে এই পাড়ায় এসে মাতৃভূমির সুখাদ্যের স্বাদ নেন এঁরা। আজ বিশেষ দিন, ফিরোজ় শাহ কোটলার টিকিট জোগাড় হয়নি, অগত্যা এখানেই। তাঁদের এক জন নাজামুদ্দিন নাসার। বলছেন, “কিছুতেই টিকিট পেলাম না। তাই টিভিতেই দেখছি। ব্যাডমিন্টন আমার প্রিয় খেলা হলেও, দেশে ক্রিকেট নিয়ে আবেগ বাড়ছে দেখছি।” কন্দহর থেকে ছ’বছর আগে দিল্লি এসেছেন নাসার। এখন তাঁর পিএইচ ডি প্রায় শেষের মুখে। ভারত-আফগানিস্তান বাণিজ্যপথ তাঁর গবেষণার বিষয়। “এই দলটিকে ঘিরেই সম্ভবত আমাদের দেশে ক্রিকেট এতটা জনপ্রিয় হয়েছে। সবাই যেন একটু শ্বাস নিতে পারছেন ক্রিকেট দেখে। তবে আফগান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে, তা কেউ জানে না।’’ এর বেশি আর ব্যাখ্যা করতে চাইলেন না যুবকটি।
তালিবান জমানায় বন্ধ হয়েছে মহিলাদের ক্রিকেট। রশিদ, মহম্মদ নবিদের সুরক্ষার জন্য অন্য পথ বেছে নিয়েছেন আফগান ক্রিকেট সংস্থার কর্তারা। দেশের সেরা ২৪ জন ক্রিকেটারের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে বসবাস করার ভিসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আফগানিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দল সে দেশেই এখন ‘হোম ম্যাচ’ খেলে। কারণ, বিশ্বের কোনও দেশই তাদের দেশে গিয়ে খেলতে রাজি নয়। তা ছাড়া দুবাইয়ে অনুশীলনের পরিকাঠামো ভাল। আমিরশাহিতে সারা বছর জাতীয় দলকে রাখা ও অন্য সব ব্যবস্থা করতে আফগান ক্রিকেট বোর্ডকে সাহায্য করছেন প্রাক্তন নির্বাচক আসাদুল্লাহ খান। তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা সবই ছিল। সেই পরিস্থিতি কাটানো গিয়েছে। আফগানিস্তানে এখনও ক্রিকেট বেঁচে আছে।’’ তবে ক্রিকেটকে ‘তালিবানের খেলা’ বলে তিক্ততা প্রকাশ করতেও দেখলাম লাজপতনগরের এই বাজারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আফগান যুবকের স্টেশনারি আর শুকনো ফলের দোকান। সেই দোকানে রেডিয়ো পর্যন্ত চলছে না। প্রশ্ন করতে জবাব এল, “আমি ক্রিকেট মোটেই পছন্দ করি না। ওটা তালিবানি খেলা। আমার প্রিয় ফুটবল আর সাঁতার।’’ কাবুলে একটি ইঞ্জিনিয়ারং কলেজে পড়ছিলেন তিনি। তালিবানের ক্ষমতা দখলের সময়ে পালিয়ে চলে এসেছেন নয়াদিল্লি। ভিসাও নেই তাঁর।
উজ্জ্বল এই ছাত্রটির অন্ধকার মুখে তাঁর দেশের ক্রিকেট কোনও আলো ফেলতে পারছে না।