প্রতীকী ছবি।
বসন্তের দুপুর। তায় রবিবার। ২২ গজের লড়াই তখন জমজমাট। দিল্লি পুলিশের বাৎসরিক প্রদর্শনী ম্যাচ তখন পুরোদমে চলছে দিল্লির কনট প্লেসের কাছে বড়াখাম্বা রোডের একটি বেসরকারি স্কুল মাঠে। মাঠ থেকে মেরেকেটে দশ কিলোমিটার দূরে জাফরাবাদ। গন্ডগোলের আশঙ্কা করে সেখান থেকে একের পর এসওএস আছড়ে পড়ছে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে— ‘ভিড় জড়ো হচ্ছে’, ‘জনতা উত্তেজিত’, ‘বড় ঝামেলা হতে পারে’, ‘ফোর্স চাই’! অভিযোগ, সেই জরুরি বার্তাকে আমলই দেননি মাঠে উপস্থিত বা খেলায় ব্যস্ত দিল্লি পুলিশের কর্তারা। এমনকি খেলা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত মাথা ঘামানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি। দিল্লিতে হিংসার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, তখন তৎপর হলে ঘটনা হয়তো এত দূর গড়াত না।
তবে ক্রিকেট ম্যাচ উপলক্ষ মাত্র। দক্ষ অফিসারের অভাব, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা, সব স্তরের পুলিশকর্মীদের তলানিতে নেমে যাওয়া আত্মবিশ্বাসের প্রভাব শুধু উত্তর-পূর্ব দিল্লির হিংসা থামাতেই নয়, জামিয়া থেকে জেএনইউ সর্বত্রই দেখা গিয়েছে। বার বার ফুটে উঠেছে দিল্লি পুলিশের অদক্ষতার ছবিটিই। ১৯৮৪ সালের শিখ দাঙ্গা ও ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ কাণ্ডের পরে কিছু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ছাড়া গত তিন দশকে কার্যত বড় কোনও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি দিল্লিতে। ফলে অধিকাংশ নিচু তলার পুলিশ অফিসারের হিংসা মোকাবিলার অভিজ্ঞতা নেই। এক সময়ে দিল্লি পুলিশে কর্মরত, বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক আমলার কথায়, ‘‘অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতি হলে প্রত্যেক বাড়ির ছাদে সর্বাগ্রে পুলিশ মোতায়েন করা হত। আটকে দেওয়া হতো উপর থেকে আক্রমণের রাস্তা। এর পর প্রতিটি ঘিঞ্জি গলির দু’প্রান্ত আটকে দিয়ে সকলককে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই ঝামেলা এড়ানো সম্ভব হত।’’ কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রথম দু’দিন পুলিশ কর্মীদের ভূমিকা কী হবে, তা স্পষ্ট ছিল না বাহিনীর কাছে।
তিন দশকের কর্মজীবনে পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়ক বেশির ভাগ সময়েই ক্রাইম ব্রাঞ্চ, ভিজিল্যান্স ও প্রশাসনিক বিভাগে কাটিয়েছেন। অভিযোগ, এর ফলে ব্যর্থ তিনি ও তাঁর বাহিনী। বিরোধীদের প্রশ্ন, যে কার্ফু মঙ্গলবার জারি করা হল, তা কেন রবিবারেই হল না। সোমবার কেন ‘দেখা মাত্র গুলি’র আদেশ দেওয়া হল না? রয়েছে গোয়েন্দা ব্যর্থতাও। পরিস্থিতি যে এতটা খারাপ হতে পারে, তা আগে আঁচ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ গোয়েন্দারা। উত্তর-পূর্ব দিল্লির ওই মিশ্র এলাকাগুলিতে দু’পক্ষই যে পেট্রল বোমা, ইট, বন্দুক জমা করছে, বাইরের রাজ্য থেকে লোক ঢুকছে, বাড়ি-বাড়ি চিহ্নিতকরণ হচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপের বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে ভিড়কে জমা হতে বলা হচ্ছে, তা নিয়ে অন্ধকারে ছিলেন গোয়েন্দারা।
বাহিনীর উঁচু ও নিচুতলার মধ্যে অনাস্থাও একটি বড় কারণ বলে বলা হচ্ছে। গত বছর আইনজীবীদের সঙ্গে দিল্লি পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় দিল্লি হাইকোর্ট দুই পুলিশ অফিসারকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেয়। যে ঘটনায় নিচুতলার কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন পুলিশ কমিশনার। অভিযোগ ওঠে, সে সময়ে সংঘর্ষ রুখতে যে পুলিশরা তৎপর হয়েছিলেন, তাঁদের সমালোচনা করেন কমিশনার। ক্ষুব্ধ পুলিশকর্মীরা পুলিশের সদর দফতরেই ধর্নায় বসে পড়েন, যা দিল্লি পুলিশের ইতিহাসে হয়নি। একই ভাবে জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে অতিসক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে, তাদের পাশেও দাঁড়ায়নি কেউ। ফলে বিচ্ছিন্নতাবোধ বেড়েছে বাহিনীতে। তাই সংঘর্ষ হচ্ছে দেখেও আগ বাড়িয়ে পদক্ষেপ করেননি পুলিশ কর্মীরা।