বিচারপতি এস মুরলীধর
দিল্লি হাইকোর্টের বিরাট হলঘরে পা রাখার জায়গা নেই। সিঁড়ি ও ব্যালকনির প্রতি ইঞ্চিতে শুধুই কালো কোট পরিহিত আইনজীবীরা।
কোনও বিচারপতির বিদায় সংবর্ধনায় গান বা কবিতা ব্রাত্যই থাকে। প্রথা ভেঙে দিল্লি সরকারের আইনজীবী রাহুল মেহরা প্রথমে ‘একলা চলো রে’ গাইলেন। তার পরে উর্দুতে শের শোনালেন, ‘ম্যায় আকেলা হি চলা থা জানিব-এ-মঞ্জিল মগর লোগ সাথ আতে গয়ে অউর কারবাঁ বনতা গয়া’।
দিল্লি হিংসার আগে উস্কানিমূলক বিবৃতি দেওয়ার জন্য বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি এস মুরলীধর। সে রাতেই কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে পঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলির নির্দেশ পান। আজ তাঁর অভূতপূর্ব বিদায় সংবর্ধনার সাক্ষী রইল দিল্লি হাইকোর্ট।
বদলি ঘোষণার পরে বিদায় সংবর্ধনা বিচারপতি মুরলীধরকে। বৃহস্পতিবার দিল্লি হাইকোর্টে। পিটিআই
২৬ ফেব্রুয়ারির বদলির দিনটাকে ‘দীর্ঘতম কাজের দিন’-এর তকমা দিয়েছেন বিচারপতি মুরলীধর। তার আগের দিন রাত সাড়ে ১২টায় তিনি নিজের বাড়িতে আদালত বসান। দিল্লির হিংসার ফলে বহু মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে আইনজীবীরা তাঁর কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন। সে রাতেই তাঁর প্রিয় পোষা ল্যাব্রাডরও মারা যায়।
তার পরে সকালে উস্কানিমূলক বিবৃতির বিরুদ্ধে মামলার শুনানিতে বসেন। কেন্দ্রের যুক্তি ছিল, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামই তাঁকে পঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলির সুপারিশ করেছিল। কলেজিয়াম সূত্রের বক্তব্য, ভবিষ্যতে বিচারপতি মুরলীধর ওই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হবেন ভেবেই তাঁকে বদলি করা হচ্ছে। আজ বিচারপতি মুরলীধর নিজে বলেন, ‘‘১৭ ফেব্রুয়ারি কলেজিয়াম থেকে চিঠি দিয়ে আমাকে বদলির সুপারিশের কথা জানানো হয়। আমি আপত্তি জানাইনি।’’ মজা করে বলেন, ‘‘বদলি করলেও আমাকে দেশের সেরা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির পদ থেকে কেউ সরাতে পারবে না।’’
বিচারপতির আসনে বসে দুর্বল-প্রান্তিক মানুষের হয়ে দাঁড়ানোর জন্য সমাদৃত বিচারপতিকে সম্মান জানাতে আজ আইনজীবীরা বলেন, দিল্লি হাইকোর্টের ‘কোহিনুর’-ই চলে যাচ্ছেন। বিদায় সংবর্ধনার আগে প্রধান বিচারপতির এজলাসে সমস্ত বিচারপতিরা একত্র হয়ে তাঁকে সম্মান জানান। হাজির হয়েছিলেন হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এ পি শাহ-ও।
বিচারপতি শাহ ও বিচারপতি মুরলীধরের বেঞ্চ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা খারিজ করে দিয়ে রায় দিয়েছিলেন, সমকামিতা অপরাধ নয়। পরে সুপ্রিম কোর্ট যাতে সিলমোহর বসায়। আজ বিচারপতি মুরলীধর বলেন, ‘‘সে দিন এজলাসের মধ্যেই যেভাবে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তখনই বুঝেছিলাম কিছু অপরিবর্তনীয় ঘটনা ঘটছে।’’
ভবিষ্যতেও তিনি যে প্রান্তিক, দুর্বল মানুষের হয়ে ঝুঁকে থাকবেন তা বুঝিয়ে বিচারপতি বলেন, ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে কার ক্ষমতা বেশি, তা বিচার করতেই হবে। সমান ন্যায় করতে দুর্বলের দিকেই ঝুঁকে থাকতে হবে। গাঁধীর দুর্বলতমের পাশে দাঁড়ানো ও অম্বেডকরের সাংবিধানিক নৈতিকতার নীতি মেনে চলতে হবে। বিচারপতি মুরলীধর জানান, ৮০ বছর বয়সি কাউকে পেনশন পাইয়ে দিতে পারলে, মৃত বাস কন্ডাক্টরের পরিবারকে সুরাহা দিতে পারলে বা নিয়মের ভুলে চাকরি যাওয়া সিআরপি জওয়ানকে তা ফিরিয়ে দিতে পারলেই তিনি বেশি তৃপ্তি পান।
দিল্লি থেকে বিদায়ের দিনে আজ মুরলীধর জানিয়েছেন, আইনজীবী হওয়ার কথা ভাবেনইনি। এক আইনজীবীর ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে তাঁর চেম্বারে ক্রিকেট খেলার ব্যাগ রাখতেন। সেখান থেকেই আইনে আগ্রহ তৈরি।