গ্রামের রবিনহুড পুলিশের জালে। ছবি-সংগৃহীত
পুলিশ গিয়েছে চোর ধরতে। কিন্তু, গ্রামের লোক তাকে চোর বলে মানতে নারাজ। সে তো তাদের কাছে ‘ভগবান’!
শেষে নানাবিধ প্রমাণ দেখিয়ে গ্রামের লোককে বোঝান গোয়েন্দারা। তাতে যদিও গ্রামবাসীদের ধারণার কোনও বদল হয়নি। তবে, গ্রেফতার হয়েছে সেই ‘চোর’।
দিল্লি এবং তার আশপাশের এলাকায় বেশ কিছু দিন ধরেই চুরি হচ্ছিল। মূলত, অবস্থাপন্ন বাড়িগুলি থেকেই ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাচ্ছিল টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি, মোবাইল, ঘড়ির সঙ্গে নানা দামি জিনিসপত্র। শেষে নিউ ফ্রেন্ডস কলোনির একটি বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে চোরের হদিশ পায় পুলিশ। সেখান থেকে সে লাখখানেক টাকার জিনিস চুরি করে। কিন্তু, তাকে ধরতে গিয়ে পুলিশ বেশ বিপাকে পড়ে। চোরের গ্রামের বাড়িতে তাকে ধরতে গিয়ে প্রথমে তাদের মনে হয়, এ চোর তো আসলে ‘রবিন হুড’! পরে সেই ধারণা পাল্টে যায়। বোঝা যায়, গ্রামের লোকের কাছে নাম কিনে সে আসলে রাজনীতিতে নামার রাস্তা তৈরি করছিল।
আরও পড়ুন- চলছে মস্তিষ্কের জটিল অস্ত্রোপচার, অপারেশন টেবিলেই গিটার বাজাচ্ছেন যুবক!
পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত চোরের নাম মহম্মদ ইরফান। দিল্লির জামিয়ানগরে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত বছর সাতাশের ওই যুবক। দিল্লির একাধিক চুরির ঘটনার পর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পুলিশ যখন নিশ্চিত, চুরিগুলি আসলে ইরফানই করেছে, তত ক্ষণে পাখি পালিয়ে গিয়েছে। তদন্তে নেমে পুলিশ তার বিহারের বাড়ির সন্ধান পায়। এর পরেই তারা সেখানে তল্লাশি দল পাঠায়। কিন্তু, সীতামঢ়ী জেলার পুপরি থানার জোগিয়া গ্রামে পৌঁছে গোয়েন্দাদের অবাক হওয়ার শুরু। ইরফানের ছবি যাঁকেই দেখাচ্ছেন, তাঁরাই বলছেন, ‘এ তো উজালাবাবু। আমাদের ভগবান।’ পুলিশ তার ‘চোর’ পরিচয় দেওয়ার পর তাঁরা আকাশ থেকে পড়েছেন।
কারও মেয়ের বিয়েতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে ইরফান। তো কারও চিকিত্সার খরচ হিসাবে দিয়েছে ১০ হাজার। গ্রামে নিয়মিত স্বাস্থ্য শিবির করে। ধরা পড়ার আগের সপ্তাহেও সেই শিবির হয়েছে। গ্রামে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি ‘উজালাবাবু’র সাহায্য পাননি! মুসলিম অধ্যুষিত ওই গ্রামে যে চার ঘর হিন্দু পরিবার থাকে, তাদের মধ্যে যোগীন্দ্র রামকেই তো সে দু’বার বেশ কয়েক হাজার টাকা দিয়ে ‘বিপদ’ থেকে উদ্ধার করেছে। রামসতীর মতো তরুণীর বাচ্চা হওয়ার সময়েও দিয়েছে কয়েক হাজার টাকা। তাই, গ্রামের প্রত্যেকের কাছেই সে ‘মসীহা’। ফলে, তারা ইরফানের এই কীর্তি বিশ্বাসই করতে পারেনি। গত ৬ জুলাই সীতামঢ়ীর একটি হোটেল থেকে যখন ইরফানকে বমাল সমেত গ্রেফতার করা হয়, তার পরে আর কেউ মুখ খুলতে চাননি। তার কাছ থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকার চোরাই জিনিসপত্র উদ্ধার হয়েছে।
ইরফানকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করে, তখন তার হাতে ছিল নামী কোম্পানির একটি ঘড়ি। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, সে যখন গ্রামে আসত তখন নিত্যনতুন গাড়ি নিয়ে আসত। পোশাকআশাকেও ধোপদুরস্ত। কিন্তু নিজেকে বড় ব্যবসায়ী পরিচয় দেওয়ায় কেউই কোনও সন্দেহ করেননি। পুলিশ জানিয়েছে, সম্প্রতি ইরফান একটি দামি গাড়ি কেনে। আসলে চোরাই জিনিসপত্র বিক্রি করেই সে ওই গাড়ি কিনেছিল। শুধু গাড়ি নয়, বিলাসব্যসনের প্রচুর সামগ্রীও কিনত সে। শুধু ব্যবসায়ী পরিচয় নয়, ভোজপুরী এক নামী অভিনেত্রীর ছবি দেখিয়ে সে জানিয়েছিল, তিনি তার স্ত্রী। সকলে বিশ্বাসও করেছিলেন সে কথা।
আরও পড়ুন- কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার প্রাক্তন জাতীয় কুস্তিগীর
গ্রামের মানুষের মতোই অবাক ইরফানের পরিবারের লোকজনও। জোগিয়া গ্রামের ওই বাড়িতে তার বৃদ্ধা মা, দুই বোন, দুই দাদা, বৌদি এবং প্রথম পক্ষের দুই মেয়ে থাকে। বেশ ঝাঁ-চকচকে সেই বাড়িও ইরফানের গ্রেফতারির খবরে ভীষণ অবাক। তার মা নসীমা খাতুন যেমন দাবি করেন, তাঁর ছেলেকে ফাঁসানো হয়েছে। এমন কাজ সে করতেই পারে না। তিনি আরও জানান, ইরফানের প্রথম পক্ষের বউ পরিবার ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তার পর যে ভোজপুরী অভিনেত্রীকে বিয়ে করেছে ছেলে, তিনি কখনও এ বাড়িতেই আসেননি।
তবে, ইরফান নিজে সবটাই স্বীকার করেছে। তার দাবি, এলাকার রাজনীতিতে নাম লেখানোর উদ্দেশ্যেই সে গ্রামের মানুষকে সাহায্য করত। তবে চুরিটা তার পেশা। দীর্ঘ দিন ধরেই সে এই চুরির ‘কাজ’ করে যাচ্ছে। দিল্লি পুলিশের ডিসিপি রোমিল বানিয়া জানিয়েছেন, এলাকার মানুষের কাছে নিজের ইমেজ ধরে রাখতে সে মাঝেমাঝেই ফেসবুকে পাজামা-কুর্তা পরা ছবি পোস্ট করত। গ্রামের স্বাস্থ্যশিবিরের মতো ছোটখাটো আয়োজনের ছবিও দিত সে। তবে, দিল্লিতে তার খুব একটা সুনাম ছিল না। বেশ কিছু দিন আগে দিল্লির এক বারে সে নাকি ১০ হাজার টাকা উড়িয়েছে। ডিসিপি আরও জানান, তাঁদের কাছে ইরফান দাবি করেছে, চুরি করতে যাওয়ার সময় সে কখনও জুতো বা স্লিপার পরত না। কারণ সে বিশ্বাস করত, এতে গৃহস্বামী জেগে যেতে পারে।
কিন্তু এত সন্তর্পণে ‘কাজ’ করার পরে ‘ভগবান’কে যে এ ভাবে ধরা পড়ে যেতে হবে তা কি ‘উজালাবাবু’ কখনও ভেবেছিল!