পুরনো ঔরঙ্গজেব রোড। (ডান দিকে) পুস্তা সড়কে বুধবার এই বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক আসিফ মহম্মদ খান।
রাস্তার নাম নিয়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে বিতর্ক হয়। মার্টিন লুথার কিঙ্গ-এর নামে রাস্তা হবে কি না, তা নিয়েও মার্কিন মুলুকে বিতর্ক কম হয়নি। কংগ্রেস জমানায় ব্রিটিশ স্মৃতি-বিজড়িত কনট প্লেসের নাম বদলে রাজীব চক করা হয়েছিল। নাম বদলের রাজনীতির সাক্ষী কলকাতাও।
ঔরঙ্গজেব রোডের নাম পাল্টে শিখগুরু গোবিন্দ সিংহের নামে রাস্তা করতে চেয়েছিলেন অকালির নেতারা। সেই মর্মে তাঁরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে অনুরোধও করেন। কিন্তু বাজপেয়ী কখনও এই নাম বদলানোর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। দিল্লি বিজেপির পক্ষ থেকেও বারবার ঔরঙ্গজেব রোডের নাম বদলানোর দাবি উঠেছিল। কিন্তু সেই দাবি এত দিন মানা হয়নি।
এ বার বিজেপি পরিচালিত নয়াদিল্লি পুরসভা ঔরঙ্গজেব রোডের নাম বদলানোয় দেশ জুড়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। নামকরণ হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় এখন উল্টে এই নাম বদলানোর রাজনীতিটাই নরেন্দ্র মোদী সরকারের শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে রাহুল গাঁধী এটা নিয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাননি। আব্দুল কালামের নামে রাস্তার নাম দেওয়ার বিরোধিতা করাটাও কংগ্রেসের পক্ষে অস্বস্তিকর। তবে সরাসরি বিরোধিতা না করলেও দিল্লি কংগ্রেসের এক প্রাক্তন বিধায়ক আসিফ মহম্মদ খান কাল ওখলার কাছে যমুনার ধারে তিন কিলোমিটার একটি রাস্তার নামকরণ করে দিয়েছেন ‘ঔরঙ্গজেব রোড’। কালিন্দী কুঞ্জ থেকে জামিয়া নগর পর্যন্ত এই তিন কিলোমিটার রাস্তাটির এত দিন কোনও নাম ছিল না। এটি পুস্তা সড়ক বলে পরিচিত ছিল। এই রাস্তাটিতে কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ে একটা সবুজ রঙের নামের বোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে ইংরেজি, হিন্দি এবং উর্দুতে লিখে দেওয়া হয়েছে ‘ঔরঙ্গজেব রোড’।
সরাসরি কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এই কাজ করা না হলেও প্রাক্তন এই বিধায়ক জানিয়েছেন, এখন থেকে যে কোনও রাস্তার নাম সরকার বদলালে, তা সে আকবরের নামেই হোক বা অশোকের, তাঁরা ফের নতুন কোনও রাস্তার নাম সেই ঐতিহাসিক চরিত্রের নামে করে দেবেন। প্রাক্তন বিধায়কের কথায়, ‘‘বহু রাস্তার কোনও নামই নেই। আমরা সেই সব রাস্তাকেই বেছে নেব।’’ যা শুনে বিজেপি নেতা শাহনওয়াজ হোসেনের দাবি, ‘‘এটা কংগ্রেসের বিচিত্র রাজনীতি। ঔরঙ্গজেবের বদলে আব্দুল কালামের নাম হয়েছে বলে এত গোঁসা কেন? আব্দুল কালামকে কি কংগ্রেসের পছন্দ নয়? আর অতীতে যখন রাজীব গাঁধীর নামে কনট প্লেসের নামকরণ করা হয়েছিল, তখনও কি শাহি দিল্লির ঔপনিবেশিক ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়নি?’’ যার জবাবে কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদ বলেন, ‘‘অভিযোগটা আসলে নামকরণ নিয়ে নয়। আব্দুল কালামকে নিয়ে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। সমস্যা হল, বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। বিজেপি একটি সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্বের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিষয়টিকে দেখছে, সমস্যাটি সেখানেই।’’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি সূত্র বলছে, সেই ১৯৭৫ সাল থেকে রাস্তার নাম বদলানোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট কেন্দ্রীয় আইন আছে। সেই আইন অনুসারে কোনও ঐতিহাসিক চরিত্রের নামে নামকরণ করা রাস্তার নামই বদলানো যায় না। এর কারণ দু’টি। প্রথম কারণ, দীর্ঘদিনের অভ্যাস বদলালে ডাকঘর এবং স্থানীয় মানুষের অসুবিধা হয়। আর দ্বিতীয় কারণ, ইতিহাস মোছার চেষ্টা অনুচিত। ঐতিহাসিক চরিত্র ভাল না খারাপ, সেটি বড় কথা নয়। কিন্তু ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা অনুচিত। তবে দিল্লি পুরসভার এক সূত্রের দাবি, আইনের বিশেষ ধারা অনুযায়ী তারা রাস্তার নাম পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। ফলে ঔরঙ্গজেব রোডের নাম পাল্টে ফেলার এই পদক্ষেপ বেআইনি নয়।
একই কথা বলছেন ইতিহাসবিদেরা। মহাত্মা গাঁধীর প্রপৌত্র গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর কথায়, ‘‘এই ঔরঙ্গজেবীয় ‘সেন্সরশিপ’ আসলে ঔরঙ্গজেবকেই আবার প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। যে ভুল অটলবিহারী বাজপেয়ী করেননি, সেই ভুল এনডিএ জমানায় হল। আসলে ঔরঙ্গজেবকেই আবার বাঁচিয়ে তোলা হল।’’ ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার বলছেন, ‘‘এক সময় কলকাতায় অতি বামপন্থীরা বঙ্কিমচন্দ্র এবং বিদ্যাসাগরের মূর্তির গলা কেটেছিল। এ সব করে ঐতিহাসিক চরিত্র মুছে ফেলা যায় না। সেই চরিত্রগুলো আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতা পায়। ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে বিদ্যাসাগর বা বঙ্কিমচন্দ্রের তুলনা করছি না। শুধু বলতে চাইছি, রাস্তার নাম বদলে বা সাইনবোর্ডে আলকাতরা লাগিয়ে ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না।’’ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবও ঔরঙ্গজেব রোডের নাম পাল্টানো প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপ। প্রাচীন বা মধ্য ভারতের ইতিহাসে এমন অনেক শাসক রয়েছেন, যাঁদের সম্পর্কে অনেকেই নানা বিষয়ে আপত্তি তুলতে পারেন। কিন্তু সেই সব নাম তো পাল্টে ফেলার কথা উঠছে না!’’
কংগ্রেসের এই প্রাক্তন বিধায়ক যে রাস্তার নামকরণ করেছেন, সেটিও কি অবৈধ নয়? দক্ষিণ দিল্লির পুরসভার মুখপাত্র মুকেশ যাদব বলেন, ‘‘এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। রাস্তার নামকরণের একটি বৈধ প্রক্রিয়া রয়েছে। যে হেতু এখনও এই রাস্তার নামকরণ নিয়ে কেউ অভিযোগ দায়ের করেনি, তাই আমরা কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছি না। কেউ অভিযোগ জানালেই ব্যবস্থা নেব।’’
কংগ্রেস অবশ্য পুরো ব্যাপারটা সুকৌশলে সেরে ফেলার চেষ্টা করছে।
এক দিকে প্রাক্তন বিধায়ক ‘নামকরণের’ কাজটি সেরে ফেলেছেন। অন্য দিকে, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের মিডিয়া উপদেষ্টা পবন খেরা এক বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘‘পুরসভা কেন শুধু ঔরঙ্গজেবের নামে রাস্তার নাম পাল্টাল? সম্রাট অশোক থেকে শুরু করে সমস্ত ঐতিহাসিক ব্যক্তির নামে থাকা রাস্তার নাম বদলে সমকালীন ব্যক্তিত্বের নামে করে দিচ্ছে না কেন?’’
মোদী ও রাজনাথ সিংহ, দু’জনেই এখন এই নামকরণের রাজনীতি নিয়ে প্যাঁচে পড়েছেন। ক’দিন আগে গো-হত্যা প্রসঙ্গে বিতর্কের সময় রাজনাথ বাবরকে উদ্ধৃত করে বাবরেরই প্রশংসা করেন। রাজনাথের কথায়, বাবর বলেছিলেন যে এ দেশে দীর্ঘদিন শাসন করতে গেলে বলপূর্বক অন্যের মতামতকে অগ্রাহ্য করে গো-মাংস ভক্ষণকে বাধ্যতামূলক না করাই ভাল।
এ বার দিল্লি পুরসভা যদি বাবর রোডের নাম বদলাতে চায়, তখন রাজনাথ সিংহ কী বলবেন?