দিল্লির পথে গাড়ির এই চাপ কমাতে তৎপর আপ সরকার। ছবি: এএফপি।
আজকে জোড়, তো কাল বিজোড়! নম্বরপ্লেটের শেষ অঙ্ক, আর সপ্তাহের বার গুনেই এখন ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় নামাতে পারবেন দিল্লিবাসী। বেজিং-সিঙ্গাপুরের ধাঁচেই রাজধানীতে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে এই নিয়ম। সপ্তাহের বার ও নম্বর মিলিয়ে রাস্তায় গাড়ি নামানোর নয়া নিয়ম ভাঙলে হবে জরিমানাও। রাজধানীর বাতাসে বিষ কমাতে আজ এই নিদান দিল অরবিন্দ কেজরীবালের সরকার।
ঠিক হয়েছে, নম্বরপ্লেটের শেষে যদি জোড় সংখ্যা থাকে, তা হলে সেই গাড়ি চলবে সোম, বুধ ও শুক্রবার। সপ্তাহের বাকি দিনগুলিতে পথে নামার অনুমতি পাবে বিজোড় নম্বরওয়ালা গাড়ি। বাস, ট্যাক্সি, স্কুল বাসের মতো গণপরিবহণ, অ্যাম্বুল্যান্স ও সরকারি গাড়ির ক্ষেত্রে এ নিয়ম খাটবে না। দিল্লি সরকারের বক্তব্য, রাজধানীতে ৯০ লক্ষ গাড়ি নথিভুক্ত রয়েছে। তার মধ্যে প্রতি দিন গড়ে ২৭ লক্ষ ব্যক্তিগত গাড়ি চলে। জোড়-বিজোড়ের ছাঁকনিতে এক ধাক্কায় পথে এই গাড়ির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এলে পরিবেশ কিছুটা হলেও স্বচ্ছ হবে।
শহরে বায়ুদূষণ কমাতে আজ আরও কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিল্লি সরকার। এক, দূষণ ছড়ানোয় বদরপুরের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। দুই, দিল্লি এলাকায় প্রচুর গাছ লাগানো হবে। তিন, এ বার থেকে আর রাত ন’টা নয়, এগারোটার আগে লরি বা অন্য পণ্যবাহী গাড়ি দিল্লিতে ঢুকবে না।
দিল্লি সরকারের যান নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্তকে বিভিন্ন মহল স্বাগত জানালেও প্রশ্ন উঠছে, একান্ত কোনও জরুরি প্রয়োজনে, ট্রেন বা বিমান ধরতে বা বিপদে-আপদে গাড়ি নিয়ে বেরোতে হলেও কি পড়তে হবে জোড়-বিজোড়ের গেরোয়! এই প্রশ্নও উঠছে যে, বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশে একটি চালু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়াটাই বা কতটা যুক্তিসঙ্গত? আবার দূষণ-দৈত্যকে নিয়ন্ত্রণের দায়টাও কম নয় দিল্লির। গত কালই রাজধানীকে ‘গ্যাস চেম্বার’ বলে ভর্ৎসনা করেছে দিল্লি হাইকোর্ট। অবস্থা এমনই যে, বিদেশি দূতাবাসের কর্মীদের অনেকে দিল্লিতে নিয়োগের কথা শুনলে আঁতকে ওঠেন। বায়ু দূষণের কারণে গোটা শীতকাল জুড়েই ধোঁয়া ও কুয়াশার মিশেলে তৈরি ঘন ধোঁয়াশায় (স্মগ) ছেয়ে থাকে দিল্লির আকাশ। এই স্মগের কারণেই গোটা শীতকাল জুড়ে বিমান, ট্রেন ও গাড়ি— সবই দেরিতে চলে। চিকিৎসকদের মতে, দূষিত আবহাওয়ার কারণে রাজধানী এলাকায় শিশুদের মধ্যে জন্মগত হাঁপানি ও ফুসফুসের অন্যান্য অসুখ ভীষণ ভাবে বেড়ে গিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র মতে, পৃথিবীর যে ২০টি শহরে বায়ু সব চেয়ে দূষিত, তার ১৩টিই ভারতে। এবং এগুলির শীর্ষে রয়েছে দিল্লি। হু বলছে, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী বাতাসে ধূলিকণার সহনীয় মাত্রা ৬ মাইক্রোগ্রাম। দিল্লির বাতাসে রয়েছে ১৫৩ মাইক্রোগ্রামের কাছাকাছি। যা শিশুদের ফুসফুসের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর।
দিল্লির বাতাসে কেন এত বিষ?
পরিবেশবিদ বা চিকিৎসকরা বলছেন, কারণ অনেকগুলি। l প্রথম কারণ অবশ্যই গাড়ির ধোঁয়া। l বড়-ছোট অনেক কারখানা রয়েছে দিল্লিতে ও আশপাশে। এগুলির সব ক’টিতে দূষণ নিয়ন্ত্রণের বিধি মানা হয় না ও উপযুক্ত প্রযুক্তিও ব্যবহার করা হয় না। l দিল্লির লাগোয়া পঞ্জাব-হরিয়ানায় চাষের জমিতে খড় ও আগাছা পুড়িয়ে দেওয়ার চল রয়েছে। এতে আকাশে বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি হয় ধোঁয়ার চাদর, যা ধরা পড়েছে উপগ্রহ চিত্রেও।
• দূষণ ছড়ায় বদরপুর ও দাদরির বিদ্যুৎ কেন্দ্রও। • নয়ডা ও গুড়গাঁওয়ে আবাসন শিল্প থেকেও দিল্লিতে বায়ু দূষণ ক্রমে বাড়ছে। দিল্লি পরিবহণ দফতর জানাচ্ছে আরও কয়েকটি কারণের কথা। • গড়ে প্রতি দিন ১৪০০ নতুন গাড়ি যোগ হয় দিল্লির রাস্তায়। কিন্তু সেই অনুপাতে সবুজায়ন হচ্ছে না। • দিল্লি তথা ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিওনে আবাসন শিল্পের বাড়বাড়ন্তের কারণেও নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে ক্রমশ বাতাসের ক্ষতিকর পদার্থ বাড়ছে।
তবে সব ছাপিয়ে গাড়ির দূষণই যে দিল্লিকে বিপদে ঠেলছে বেশি, গত মাসের এক পরীক্ষাতেও তা ধরা পড়েছে। গত ২২ নভেম্বর পুরনো দিল্লির একটি এলাকাকে ‘কার ফ্রি’ ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে ওই এলাকায় দূষণের মাত্রা এক ধাক্কায় অনেকটাই নেমে এসেছিল। এমন পরীক্ষা হয়েছে গুড়গাঁওয়েও। এরও আগে ২০০৭ সাল নাগাদ দিল্লির বাতাসকে শুদ্ধ করতে পদক্ষেপ করেছিল তৎকালীন দিল্লি সরকার। বাস, অটো, ছোট আকারের পণ্যবাহী বাহনকে সে সময়ে সিএনজি পরিষেবার আওতায় নিয়ে আসা হয়। বছর দু’য়েক দিল্লির বাতাস কিছুটা স্বচ্ছ থাকলেও, ফের ২০১০ সালের পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে।
বিষয়টির সমাধানে সরকার কী ভাবছে, তা আগামী ২১ ডিসেম্বরের মধ্যে আদালতকে জানাতে নির্দেশ দিয়েছে দিল্লি হাইকোর্ট। তার পরেই আজ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয় কেজরীবাল প্রশাসন। শহরের পথে ব্যক্তিগত গাড়ি অর্ধেক করা যার অন্যতম। বদরপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি দিল্লির উপকণ্ঠে দাদরি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও বন্ধ করার জন্য ‘গ্রিন বেঞ্চ’-এর দ্বারস্থ হবে সরকার। দিল্লির লাগোয়া এলাকায় আবাসন শিল্প থেকে তৈরি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানা সরকারের সঙ্গে বসে সামগ্রিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে।
আপ সরকারের আশ্বাস, জোড়-বিজোড় নীতির কারণে মানুষের যাতে অসুবিধে না হয়, তার জন্য আরও বেশি সরকারি বাস চালানো হবে। পরিবহণ দফতর জানিয়েছে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের স্কুল বাসগুলির কোনও কাজ থাকে না। সেগুলিকে যাত্রী পরিবহণের কাজে ব্যবহার করা হবে প্রয়োজনে। বেশি রাত পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা চালু রাখার জন্য মেট্রো কর্তৃপক্ষকেও অনুরোধ করেছে দিল্লি সরকার। বাতাসে ধুলো কমাতে ঝাড়ুদারদের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে।
কিন্তু এতে কি সমস্যা মিটবে? কিছুটা আশাবাদী পরিবেশ সংগঠন টেরি-র সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের গবেষক অরিন্দম দত্ত। তাঁর মতে, ‘‘রাস্তায় গাড়ির চাপ কমলে বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থ কমতে বাধ্য। যে গাড়িগুলি চলবে সেগুলির ‘ফিট’ শংসাপত্র রয়েছে কি না তা-ও দেখাটা দরকার।’’ অরিন্দমবাবু জোড়-বিজোড় নীতির একটি ফাঁকের কথাও মনে করালেন এই সূত্রে। বেজিংয়ে এমন নিয়ম চালু করার পরে দেখা যায়, অনেকেই আর একটি গাড়ি কিনে যাতায়াত শুরু করেছেন। ফলে ফের দূষণ ফিরে আসে শহরে। দিল্লিবাসীও কি এ বার জোড়-বিজোড় মিলিয়ে জোড়া গাড়ির মালিক হতে চাইবেন!