জাস্সি কৌর। নিজস্ব চিত্র
গোটা বছর মাটির তলায় মূক হয়ে থাকে ঝলসানো শরীর আর পোড়া ভিটের গল্পগুলো। ভোট কাছে এলে অথবা কোনও রাজনৈতিক ‘প্রয়োজন’ দেখা দিলে তারা উজিয়ে ওঠে।
‘‘এখন তো সেই সময় এসেছে। তাই ফের তোমরাও আসছ। ছত্রিশ বছর কেটে গেল। আর কী জানতে চাও? আমি তো দেখতেও পাই না ভাল। যা হোক, এসেছ যখন বোসো।’’
ত্রিলোকপুরী পুলিশ থানার ঠিক উল্টো দিক থেকে চুরাশির শিখ দাঙ্গায় গৃহহারা, স্বামী-সন্তানহারাদের ‘বিধবা কলোনি’ শুরু। যা আগে ছিল ডিডিএ কলোনি। ঘরবাড়িগুলোর পাঁজর এখন শতখান। এমনই এক বিপজ্জনক বাড়ির সামনের রাস্তায় ইন্দির ঠাকরুনের মতো জ্যামিতিখচিত মুখে খাটিয়ায় বসে রয়েছেন জাস্সি কৌর। বয়স নির্ঘাৎ নব্বইয়ের উপরে। সংবাদমাধ্যম থেকে এসেছি শুনেই, রাস্তার মুখের একটি ছোট জটলা পরামর্শ দিল, সোজা জাস্সির কাছে যেতে। তিনি যেন এখানকার সম্মিলিত বিষাদকে বুকে ধারণ করে চলেছেন।
মোটা চশমার আড়ালে ঘোলাটে চোখ কি চকচকে হয়ে উঠল স্মৃতিচারণে? গত তিন দশকে বারবার এ কাহিনি বলতে হয়েছে গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমের সামনে! চুরাশির সেই সকালে স্বামী আর ছেলেকে খাবার বেড়ে দেওয়ার কথা। যে খাওয়া আর শেষ হয়নি। দলে দলে লোক ঢুকে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ঘরে। চোখের সামনে দগ্ধ হয়েছেন স্বামী, পুত্র, নাতি। ছেলে মধু সিংহের শেষ কথা মনে গেঁথে গিয়েছে জাস্সির, ‘‘মা, আমাকে বাঁচাও! যে ভাবে হোক বাঁচাও।’’
এই আর্তনাদের প্রতিধ্বনি এখানকার ঘরে ঘরে। সামনে ভোট এলে স্তিমিত হয়ে আসা শোকের পুকুরে ঢিল পড়ে। অমিত শাহ এখনও শিখ দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে বিঁধছেন সনিয়া-রাহুলকে। শুনে হতাশ গলায় জাস্সির খাটিয়ার কোণায় এসে বসা প্রতিবেশী হরকিষেন সিংহ বললেন, ‘‘তিন দশক ধরে সবাই তো রাজনীতিই করে এসেছে আমাদের নিয়ে। ফায়দা নিয়েছে।’’
ত্রিলোকপুরী থেকে উৎখাত হয়ে এক বছর বিভিন্ন ত্রাণশিবিরে থাকার পর ৯৯৫টি ভাঙাচোরা পরিবারকে এখানে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল রাজীব গাঁধীর সময়ে। তার পর কেউ আর খোঁজ নিতে আসে না ভোটের সময় ছাড়া। ‘‘নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে প্রচারে বলেছিলেন, জিতে এলে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের সন্তানসন্ততিদের চাকরি দেবেন। আমরা সবাই মোদীকে ভোট দিয়েছিলাম। পরে বুঝেছি সে ছিল নেহাত কংগ্রেসকে চাপে ফেলার চাল। বিজেপি সরকারেরও তো ছ’বছর কাটল। চাকরির নামগন্ধও নেই। এ-ও বলা হয়েছিল, কমলনাথ, জগদীশ টাইটলার, সজ্জনকুমারদের কড়া
সাজা হবে। সব ভাঁওতা’’, বলছেন ভাজির সিংহ।
দাঙ্গার সময় কিশোর ভাজি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন চুল-দাড়ি কাটা ছিল বলে! এখন ভাড়ার অটো চালিয়ে দিন যায়। ‘‘অকালি আমাদের কাজে লাগিয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে। বিজেপিও। আর কংগ্রেস তো কেউ কথা রাখেনি
ভয়েই ঢোকে না এখানে। এক বার বিধানসভা ভোটে বুথ খুলেছিল কলোনির মধ্যে। মহিলারা গিয়ে ভাঙচুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।’’
জরাজীর্ণ ডিডিএ ফ্ল্যাটগুলোর উল্টো দিকে গুরু নানক মার্কেট। নামেই মার্কেট। পূতিগন্ধময় পরিবেশে কিছু মোটর পার্টস, গ্রিল আর টায়ারের দোকান। দাঙ্গায় বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়া মানুষরা রাজীবের আমলে কিছু টাকা পেয়েছিলেন। তাই দিয়ে দোকান। ‘‘বাড়ি সারানোর পয়সা নেই। ওষুধ কিনে খেতে পারেন না বুড়োবুড়িরা। বর্ষায় জল ভরে যায়। খোলা হাইড্রেনে মশার চাষ। এখানে কিসের দোকান!’’— বলছেন মোটর পার্টসের ছোট ঘুপচিতে বসা সজন সিংহ।
এ বারে অবশ্য বিজেপি এবং আপ কর্মীদের আসা-যাওয়া রয়েছে এলাকায়। ফেরার পথে বিজেপি ভোটপ্রার্থীর সাঁজোয়া জিপবাহিনীও দেখা গেল। তবে হাওয়া যে কেজরীবালের পক্ষে, সেও জানাচ্ছেন বাসিন্দারা। কিন্তু ত্রাণশিবিরে কাঠকুটো জ্বেলে সেই আগুন ঘিরে মায়েদের কান্নার স্মৃতি— তাতে মলম পড়বে কি? আশা করছে না বিধবা কলোনিতে বড় হয়ে ওঠা তরুণ প্রজন্ম।