ঝকঝকে: কেজরী-জমানায় দিল্লির সরকারি স্কুল। নিজস্ব চিত্র
দিল্লি-ভোটে সরকারি স্কুলের ছায়া যেন তিন চা-বিক্রেতার গল্প!
প্রথম জনের সঙ্গে দেখা পশ্চিম বিনোদ নগরে। কপালে তিলক কাটা অরুণ লাল যেখানে সকালের চায়ের খদ্দের সামলাতে হিমশিম, তার ঠিক উল্টো দিকেই ‘রাজকীয় সর্বোদয় বাল বিদ্যালয়’। দরজায় রক্ষী। ঝকঝকে ক্যাম্পাস। প্রার্থনার মঞ্চ, স্মার্ট ক্লাস, সিসিটিভি-র সুরক্ষা তো আছেই, রয়েছে সুইমিং পুলও। প্রথম ঝলকে মোটা ফি-এর বেসরকারি স্কুল বলে মনে হলেও, এই স্কুল সরকারি। অরবিন্দ কেজরীবালের জমানায় তৈরি।
অরুণ বলছিলেন, ‘‘আগে এই স্কুলেই আবর্জনার স্তূপ পেরিয়ে ঢোকা যেত না। ছিল না সীমানার পাঁচিলই। ঝরে পড়ত পলেস্তরা। নামমাত্র খরচে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের জন্য সেই স্কুলের ভোল বদলে দিয়েছে কেজরীবাল সরকার।’’ উপমুখ্যমন্ত্রী তথা এলাকার বিধায়ক মণীশ সিসোদিয়া নিজে সপ্তাহে অন্তত বার তিনেক এখানে আসেন বলে দাবি রক্ষীরও।
দেখে এবং কথা বলে মনে হবে, এই কারণেই গত পাঁচ বছরের যে ‘রিপোর্ট কার্ড’ দেখিয়ে কেজরীবালের আম আদমি পার্টি (আপ) এ বার ভোট চাইছে, তার একেবারে উপরে রয়েছে সরকারি স্কুলের সাফল্যের খতিয়ান। বলা হচ্ছে, সারা দেশে যে রাজ্য শিক্ষায় বাজেটের সব থেকে বেশি অংশ (২৩.৮%) ব্যয় করে, তার নাম দিল্লি। সারা দেশের গড় ১৪.৮%। প্রচার করা হচ্ছে, কী ভাবে পাঁচ বছরে ৮ হাজার ক্লাসরুম তৈরি হয়েছে। মিড ডে মিলের পাশাপাশি সমান তালে চলছে কম্পিউটার শিক্ষা। পাঠ্যক্রমে রয়েছে নতুন ব্যবসা শুরুর পথ, খুশি থাকতে শেখার মতো বিষয়ও। আপ প্রার্থীরা বলছেন, গত কয়েক বছরে আকাশছোঁয়া ফি-এর বেসরকারি স্কুলকেও দ্বাদশ শ্রেণির ফলে পিছনে ফেলে দিয়েছে নামমাত্র ফি-এর সরকারি বিদ্যালয়। বেশ কয়েক জন অভিভাবক এবং পথচলতি মানুষও বললেন, ‘‘গড়পড়তা সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো যে কেজরীবালের আমলে বদলেছে, তা ঠিক।’’
শুধু স্কুলের দাঁড়েই ভোট-বৈতরণী পার হওয়া যখন প্রায় নিশ্চিত দেখাচ্ছে, তখনই দেখা সাত-আটশো মিটার দূরের দ্বিতীয় চা-বিক্রেতার সঙ্গে। প্রথম দু’মিনিট সরকারি স্কুলের ভোলবদলের প্রশংসায় তিনিও পঞ্চমুখ। কিন্তু তারপরেই শোনা গেল, ‘‘হাওয়া ঘুরছে। পালে বাতাস লাগছে বিজেপির।’’ কিন্তু এই যে কেজরীবাল প্রচার করছেন, তাঁর সরকার চলে গেলে লাটে উঠবে ভাল সরকারি স্কুল, নিখরচার মহল্লা ক্লিনিক আর সস্তা বিদ্যুতের সুবিধা? উত্তর আসে, ‘‘এ সব তো অনেক আগে করা। নতুন কী? লোকে তো শাহিন বাগও দেখছে।’’
এই ‘জোড়া প্রচারের’ আঁচেই চায়ের জল চড়িয়েছেন ‘তৃতীয় বিক্রেতা’। বহু বছর আগে গুজরাতের এক অখ্যাত রেল স্টেশনে সেই পেশা ছেড়ে এসেছেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু দিল্লি-ভোটে কেজরীবালকে কিস্তিমাত করতে প্রচারের যে চা তিনি এবং তাঁর দল চড়িয়েছেন, তা টগবগিয়ে ফুটছে পাকিস্তান-জিন্না-জামিয়া-শাহিন বাগের আঁচে। একই সঙ্গে বিজেপির আশা, সরকারি স্কুল, সস্তা বিদ্যুৎ, মহল্লা ক্লিনিকে নিখরচার ওষুধ পেতে-পেতে তা কিছুটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে দিল্লিবাসীর। তার তুলনায় শাহিন বাগের রাস্তা রোখায় ভোগান্তি বরং অনেক টাটকা।
স্কুল নিয়েও যে আক্রমণ হয়নি, এমন নয়। বিজেপির দাবি, অনেক সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো শোচনীয়। কিন্তু সব ছাপিয়ে ‘দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায়’ কেজরীবালকে ফেলতে চাইছেন মোদী-শাহের জুটি।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ জানেন, এই গরম চায়ে ঠোঁট পোড়ার প্রবল সম্ভাবনা। তা না হলে ক্ষমতায় ফিরলে স্কুলের পাঠ্যক্রমে ‘দেশপ্রেম’ পড়ানোর প্রতিশ্রুতি কেজরীবাল হঠাৎ দেবেন কেন?