ধস নেমে বিপর্যস্ত কেরলের ওয়েনাড়। ছবি: পিটিআই।
সুদৃশ্য পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গিয়েছে সবুজ চা-বাগান আর জঙ্গল। পাহাড়ের পায়ে কুয়াশা-ঢাকা উপত্যকা। এক দিন আগে পর্যন্ত এমনটাই ছিল কেরলের ওয়েনাড়। গভীর রাতে চার ঘণ্টায় পর পর তিন বার ধস নেমে সেই ওয়েনাড়ই মঙ্গলবার সকালে পরিণত হল কাদামাটি ঢাকা বধ্যভূমিতে। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সেখান থেকে উদ্ধার হল ১২৩ জনের দেহ। তাঁদের মধ্যে ৩৭ জনের দেহ শনাক্ত করা গিয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে খবর। প্রশাসন মনে করছে, ধ্বংসস্তূপের নীচে এখনও চাপা পড়ে রয়েছেন বহু মানুষ। এই বিপর্যয়ের আবহেই মৌসম ভবন জানিয়ে দিল, বৃষ্টি এখনই থামছে না কেরলে। আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তা চলবে। ভারী বৃষ্টি, দুর্যোগ মাথায় নিয়েই পুলিশ, প্রশাসন, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সঙ্গে উদ্ধারে নেমেছে সেনাবাহিনী। বায়ুসেনা বাহিনীর হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে ধসের কারণে রাস্তাঘাট ভেঙে পড়ায় বহু এলাকায় পৌঁছতে পারেনি উদ্ধারকারী দল। প্রশাসনের আশঙ্কা, বৃদ্ধি পেতে পারে মৃতের সংখ্যা। বুধবার ওয়েনাড়ে যেতে পারেন রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। রাজ্যে দু’দিনের শোক পালনের ডাক দিয়েছে পিনারাই বিজয়নের সরকার।
গত কয়েক দিন ধরে ক্রমাগত ভারী বৃষ্টি হচ্ছে কেরলে। শেষ ২৪ ঘণ্টায় ৩৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে কেরলে। মৌসম ভবনের পরিসংখ্যান বলছে, কোনও জায়গায় প্রতি ঘণ্টায় ১৬ থেকে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে ধরা হয়, সেখানে অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে। শেষ ২৪ ঘণ্টায় কেরলে ঘণ্টায় গড়ে ১৫.৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এই ভারী বৃষ্টির কারণে মঙ্গলবার রাত ২টো থেকে ভোর ৪টের মধ্যে ওয়েনাড়ের মেপ্পাড়ি এলাকায় পর পর ধস নেমেছে। আর তার জেরে প্রায় কাদায় মিশে গিয়েছে গোটা এলাকা। ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাদামাটিতে চাপা পড়েছেন বাসিন্দারা। বিপর্যয়ের কিছু ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে (আনন্দবাজার অনলাইন সেগুলির সত্যতা যাচাই করেনি)। ওই ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, কাদার স্রোতে উপড়ে পড়ছে একের এক গাছ। ভেসে যাচ্ছে গাড়ি। কোথাও আবার তা আটকে যাচ্ছে বড় পাথরে। রাস্তায় একহাঁটু কাদাজল। কোনও কোনও বাড়ির অর্ধেকেরও বেশি জলের নীচে। বহু বাড়ি ভেঙে পড়েছে।
ধসের কারণে মেপ্পাড়ি এলাকার বহু রাস্তা ভেঙে গিয়েছে। ফলে বহু জায়গায় উদ্ধারের জন্য পৌঁছতে পারেনি প্রশাসন। আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে সকালের দিকে দীর্ঘ ক্ষণ হেলিকপ্টার ব্যবহার করেও উদ্ধারকাজ চালানো যায়নি। পরে বায়ুসেনার দু’টি হেলিকপ্টার, এমআই-১৭ এবং একটি ‘অ্যাডভান্সড লাইট হেলিকপ্টার’ উদ্ধারকাজে নেমেছে। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, পুলিশ, প্রশাসনের সঙ্গে কাজে নেমেছে সেনাবাহিনী এবং নৌসেনাবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফে জানানো হয়েছে, ২২৫ জন জওয়ান উদ্ধারকাজে নেমেছেন। তিরুঅনন্তপুরমে ১৪০ জন জওয়ান প্রস্তুত রয়েছেন। প্রয়োজনে তাঁদের আকাশপথে ওয়েনাড়ে নিয়ে আসা হবে। উদ্ধারকাজ পর্যবেক্ষণের জন্য কোঝিকোড়ে কন্ট্রোলরুমও খুলেছে তারা। কী ভাবে উদ্ধারকাজ চলছে এবং তা কোন পথে এগোবে, সে সব নিয়ে আলোচনার জন্য মঙ্গলবার আমলা, মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। কেরলের মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, উদ্ধার এবং ত্রাণের জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। আগামী দু’দিন রাজ্যে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।
মেপ্পাড়িতে মঙ্গলবার দিনভর কাদামাটি সরাতেই একের পর এক দেহ উদ্ধার হয়েছে। এখনও পর্যন্ত বহু ৩৭ জনের দেহ শনাক্ত করা গিয়েছে। বাকিদের দেহ শনাক্ত করা যায়নি। বহু জনেরই পরিবারের খোঁজ মেলেনি। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ১২৮ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। কয়েক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মুদাক্কায়ি গ্রাম থেকে ১৫০ জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরানো হয়েছে। আপাতত অস্থায়ী শিবিরে রয়েছেন তাঁরা। এখনও হদিস নেই বহু মানুষের। কেরলের মুন্ডাক্কাই, ছুরালমালা, আট্টামালা, নুলপুঝা এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহু রাস্তা ধসে গিয়েছে। একটি সেতুও ভেঙে পড়েছে।
কেরলের মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। বিজেপি কর্মীরা যাতে এই পরিস্থিতিতে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন, তা দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডাকে নিশ্চিত করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তরফে মৃতদের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে। আহতদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। বিজেপি সভাপতি নড্ডা জানিয়েছেন, আটকে পড়া মানুষজনকে উদ্ধার এবং ধ্বংসস্তূপ থেকে মৃতদের দেহ বার করে আনাই এখন লক্ষ্য সরকারের। নড্ডার কথায়, ‘‘কেরলের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির সাহায্যও সেখানে পৌঁছে গিয়েছে। রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই কাজ চলছে। প্রাথমিক লক্ষ্য হল, দেহ উদ্ধার এবং যাঁরা জীবিত রয়েছেন, তাঁদের প্রাণরক্ষা।’’
বুধবার কেরলে যেতে পারেন রাহুল এবং প্রিয়ঙ্কা। কেরলের কংগ্রেস সাংসদ কেসি বেণুগোপাল মঙ্গলবার এ কথা জানিয়েছেন। লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুলের সদ্য-প্রাক্তন লোকসভা কেন্দ্র এই ওয়েনাড়। এ বারের লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলীর পাশাপাশি ওয়েনাড় থেকেও সাড়ে তিন লক্ষের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন রাহুল। তার আগে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের অমেঠী থেকে হেরে গেলেও কেরলের ওয়েনাড় জিতিয়েছিল রাহুলকে। কিন্তু রাহুল এ বার রায়বরেলী আসনটি রেখে ওয়েনাড়ের সাংসদ পদে ইস্তফা দিয়েছেন। উপনির্বাচনে ওই আসনে প্রিয়ঙ্কাকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে কংগ্রেস। ওয়েনাড়ে বিপর্যয়ের মাঝে বুধবার দু’জনেই যেতে পারেন সেখানে।