পিনারাই বিজয়ন। —ফাইল চিত্র।
ব্যতিক্রম এক বার হয়েছে। কিন্তু আবার কি তার পুনরাবৃত্তি সম্ভব?
লোকসভা নির্বাচনে কেরলে বিপর্যয়ের পরে এই প্রশ্নই এখন তাড়া করছে সিপিএমকে! রাজ্যে ২০টি লোকসভা আসনের মধ্যে মাত্র একটি আসনে জয় পেয়েছে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন এলডিএফ। পাঁচ বছর আগের লোকসভা ভোটের মতোই। আর লোকসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে দক্ষিণী এই রাজ্যে ১৪০টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ২০টিতে এগিয়ে রয়েছে শাসক ফ্রন্ট। ভোটের ফলের প্রাথমিক পর্যালোচনায় সিপিআইয়ের মতো শরিক দল পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাজকর্মকেই দায়ী করছে ভরাডুবির জন্য। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস দাবি করেছে, রাজ্য শাসন করার ‘নৈতিক অধিকার’ হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের ইস্তফা দেওয়া উচিত। সিপিএম অবশ্য মনে করছে, ২০২১ সালে যে বিজয়নের নেতৃত্বে কেরলে নজির গড়ে পরপর দু’বার ক্ষমতায় ফিরেছিল বাম সরকার, সেই মুখ্যমন্ত্রীকেই মাঝপথে সরিয়ে দিলে ভুল বার্তা যাবে। বিজয়নকে মুখ্যমন্ত্রী রেখেই সরকারে ও সংগঠনে বেশ কিছু সংশোধনমূলক পদক্ষেপ করতে চলেছে তারা।
কেরলে লোকসভা ভোট হয়ে গিয়েছিল প্রথম দুই দফায়। তার পরে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের ধারণা ছিল, এলডিএফ এ বার ৮ থেকে ১৫টি পর্যন্ত আসন পেতে পারে! দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ‘বাস্তবসম্মত’ বিবেচনায় ৫-৬টি আসন আসতে পারে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু ফল ঘোষণার পরে দেখা দিয়েছে, রাজ্যে ২০টির মধ্যে ১৮টি আসন পেয়েছে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ। গত বারের জেতা আলপ্পুঝা হারিয়ে এ বার আলাতুর আসন জিতেছে সিপিএম। আর ত্রিশূর জিতে কেরলে খাতা খুলে ফেলেছে বিজেপি! এমন ফলের পরে সিপিএমের পলিটব্যুরো বৈঠকে তোপের মুখে পড়তে হয়েছে দলের কেরল রাজ্য নেতৃত্বকে। সূত্রের খবর, পরপর দু’বার লোকসভা ভোটে এলডিএফের এমন বিপর্যয় নিয়ে সরব ছিলেন দলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন ও দলের রাজ্য সম্পাদক এম ভি গোবিন্দন সেখানে মেনে নেন, রাজ্য সরকারের কাজে বেশ কিছু ঘাটতি থেকে গিয়েছে।
বিরোধীদের তোলা ইস্তফার দাবি বিধানসভায় দাঁড়িয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন বিজয়ন। বরং, গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় এ বার এলডিএফের ভোট যত কমেছে, ইউডিএফের ভোট-ক্ষয় তার চেয়ে বেশি হয়েছে বলে পরিসংখ্যান দিয়েছেন। কেরলের মতো রাজ্যে বিজেপির মাটি শক্ত হওয়ার দায় কংগ্রেসকেও নিতে হবে বলে দাবি করেছেন। তবে পরিসংখ্যানেরই অন্য দিক বলছে, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এলডিএফের পাওয়া ৪৫% ভোট এ বার কমে হয়েছে ৩৪.৬৩%। আর তিন বছরে ইউডিএফের ভোট বেড়েছে ৭%। রেকর্ড গড়ে তিন বছর আগে বিজয়ন যখন দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরেন, তখন বামেরা জিতেছিল ৯৯টি বিধানসভা আসন। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউডিএফ বাকি ৪১টি। এই লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে ইউডিএফ এগিয়ে ১০৯টি বিধানসভা কেন্দ্রে, এলডিএফের ‘লিড’ ২০ আসনে। বাকি ১১টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। এই পরিসংখ্যান থেকেই বাম শিবিরের বড় অংশের মত, মোদী-বিরোধিতার পাশাপাশি টানা ৮ বছরের রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়াও ভালই কাজ করেছে এই ভোটে। এবং এই জায়গা থেকে ফিরে আসা কঠিন!
বিজয়ন শিবিরের অবশ্য পাল্টা বক্তব্য, বিজেপিকে হারিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়ার জন্য মানুষ কংগ্রেসকে বেশি উপযুক্ত মনে করছেন বলেই লোকসভা ভোটে এমন ফল হচ্ছে। কিন্তু লোকসভা ও বিধানসভায় মানুষ আলাদা বিবেচনা থেকে ভোট দিচ্ছেন। এই অংশের যুক্তি, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এলডিএফ মাত্র ১৬টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে সেই এলডিএফ-ই ক্ষমতায় ফিরেছিল ৯৯টি আসন নিয়ে।
তবে একই সঙ্গে বিজয়ন বলেছেন, ‘‘লোকসভায় এলডিএফের এই ফল ধারণায় ছিল না। গভীরতর আত্মসমীক্ষা করতে হবে। ময়না তদন্ত প্রয়োজন। তার পরে কাজ সংশোধন করতে হবে, যাতে নাগরিকের কাছে কাযর্করী ভাবে পরিষেবা পৌঁছয়।’’ শরিক সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক বিনয় বিশ্বমও বলেছেন, সরকারের কাজের ত্রুটি চিহ্নিত করলেও তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইছেন না। সিপিএম সূত্রের খবর, এমতাবস্থায় কে কে শৈলজার মতো মুখকে আবার মন্ত্রিত্বে ফিরিয়ে মন্ত্রিসভায় রদবদল হতে পারে। গত বিধানসভা ভোটে এক গুচ্ছ পুরনো মুখ সরিয়ে নতুনদের সামনে এনেছিল সিপিএম। নির্বাচনী বিপর্যয়ের ধাক্কা তাদের আবার পুরনো পথে ফিরতে বাধ্য করতে পারে!