‘শহিদ স্মরণে, আপন মরণে, রক্তঋণ শোধ করো’ অথবা ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’। তরুণ প্রজন্ম ‘রক্তঋণ শোধ করো’-র মর্ম বুঝছে না। মার্কিন বহুজাতিকে চাকরির চেষ্টা করতে গিয়ে সে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান শুনতেও রাজি নয়।
নতুন প্রজন্ম সাড়া দিচ্ছে না পুরনো ভাষায়। সীতারাম ইয়েচুরি এ বার তাই সিপিএমের স্লোগানগুলোই বদলে ফেলতে চাইছেন। শুধু স্লোগান নয়— প্রচারের আদবকায়দা, কোন বিষয়ে দল নিয়মিত সরব হবে, কোন বিষয়ে হবে না, সব কিছু বদলে ফেলতে চাইছে সিপিএম। আগামী ডিসেম্বরে কলকাতার প্লেনামে এ বিষয়ে সিলমোহর দেওয়া হবে। সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছেন, নরসিংহ রাওয়ের জমানায় আর্থিক উদারীকরণ শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে আম জনতার জীবনযাত্রা আমূল বদলে গিয়েছে। তা সে শ্রমিক হোক বা কৃষক, কিংবা মধ্যবিত্ত। এই তিনটি অংশই সিপিএমের সব থেকে বড় ভোটব্যাঙ্ক। কিন্তু তিনটি অংশের মানুষই, বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা আর্থিক উদারীকরণের বিভিন্ন সুবিধা নিতে অভ্যস্ত হয়েছেন। সিপিএম প্রচার করছে, শ্রমিক-কৃষকরা শোষণের শিকার। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যেও উচ্চাশা তৈরি হয়েছে। তারাও আর্থিক সংস্কারের সুফল নিতে আগ্রহী।
এই বাস্তবতা বুঝেই সিপিএমকে বদলাতে হবে বলে মনে করছেন ইয়েচুরি। তিন দিন ধরে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনার পর আজ সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘‘শুধু স্লোগান বা প্রচারের কৌশল বদলালেই হবে না। সাংগঠনিক কাজকর্মের ধরনও পাল্টাতে হবে। দৈনন্দিন আন্দোলনে আমরা কোন বিষয়ে সরব হব, তা-ও নতুন করে ভাবতে হবে।’’
ইয়েচুরি জানান, দলের মধ্যে তিনটি কমিটি তৈরি হয়েছিল। শ্রমিক, কৃষক বা গ্রামের মানুষ এবং মধ্যবিত্তদের মধ্যে আর্থিক উদারীকরণের কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা পর্যালোচনা করে তিনটি রিপোর্টও তৈরি হয়েছে। এই রিপোর্টগুলি খতিয়ে দেখে পলিটব্যুরো কিছু পরিকল্পনা করেছে। সে গুলি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে প্রস্তাব হিসেবে পেশ করা হয়েছে। এ বারের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এ সব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নভেম্বরে ফের কেন্দ্রীয় কমিটি আলোচনায় বসবে। তার পর ডিসেম্বরে প্লেনামে গোটা বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
পশ্চিমবঙ্গ-কেরলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর লোকসভাতেও কোণঠাসা সিপিএম। নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করছেন, দলের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১১ লক্ষের মধ্যে থমকে রয়েছে। ছাত্র সংগঠনে সদস্য কমছে। গণসংগঠনের সদস্যদের মধ্যে কত জন বাস্তবে সিপিএমের মতাদর্শে বিশ্বাসী, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ রাজ্যওয়াড়ি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, গণসংগঠনের সব সদস্য আন্দোলনে যোগ দেওয়া তো দূরের কথা, পার্টিকে ভোটও দিচ্ছেন না।
সিপিএমের শীর্ষ স্থানীয় অনেক নেতাই মনে করছেন, রাজ্যে রাজ্যে যে সব বিষয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেগুলি নিয়ে দল আন্দোলনে নামেনি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আন্দোলন হয়নি। বরং কারণে-অকারণে মার্ক্সবাদী তত্ত্ব আউড়েছেন সিপিএমের নেতারা। ইয়েচুরি মনে করছেন, মার্ক্সবাদী তত্ত্বের সঙ্গে রোজকার জীবনযাত্রার সমস্যাগুলির সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু মানুষ তাত্ত্বিক ভাষা বুঝতে পারছেন না। সে জন্যই স্লোগান-প্রচার-মিটিং-মিছিলের ভাষা বদলে নেওয়া দরকার।