সিপিএমের দৈনিক মুখপত্রের শেষ প্রকাশিত সংস্করণ।
খবরের কাগজে কী ছাপা হবে, নিয়ন্ত্রণ করা হত জরুরি অবস্থায়। আর এ বার গোটা কাগজেরই প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হল মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভোলবদলে!
গাঁধী জয়ন্তীর সকালে আর দিনের আলোর মুখ দেখল না ত্রিপুরা সিপিএমের দৈনিক মুখপত্র। সংবাদপত্র-পত্রিকা প্রকাশের জন্য যে আরএনআই-এর অনুমোদন লাগে, সোমবার বিকালে নতুন করে দিয়েও সেই সম্মতি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে রাতে! কারণ— জেলাশাসক তাঁর দেওয়া পুরনো ছাড়পত্র ফিরিয়ে নিয়েছেন। রাজ্যের শাসক দল বিজেপিই স্থানীয় প্রশাসনের উপরে চাপসৃষ্টি করে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ত্রিপুরা সিপিএমের অভিযোগ। এই কাণ্ডকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপরে ‘নির্লজ্জ আক্রমণ’ হিসেবেই দেখছে সিপিএমের পলিটব্যুরো। অভিযোগ অস্বীকার করলেও বিজেপি অবশ্য সিপিএমের মুখপত্র বন্ধে উচ্ছ্বাস গোপন করছে না!
আগরতলার মেলার মাঠ থেকে প্রকাশিত ওই মুখপত্র দৈনিক হিসেবে চালু ছিল ১৯৭৯ সাল থেকে। ত্রিপুরার দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক এখন। বন্ধ করার নোটিস দেওয়ার জন্য কাগজের মালিকানা সংক্রান্ত একটি ‘টেকনিক্যাল’ কারণকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এক সময়ে মুখপত্র ছিল সরাসরি সিপিএম রাজ্য কমিটির দ্বারা প্রকাশিত, সম্পাদক ছিলেন দলের নেতা গৌতম দাশ। পরে একটি সোসাইটির হাতে কাগজের মালিকানা হস্তান্তর হয়। বদল হয় সম্পাদকও। সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য, ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে তাঁরা ওই পরিবর্তন সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র জেলাশাসকের দফতর এবং আরএনআই-এর কাছে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু আরএনআই-এর সাইটে কাগজের সম্পাদকের নাম বদল হয়নি। কয়েক মাস আগে চোখে পড়ার পরে রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিকাশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরামর্শ করে কাগজ পরিচালনার ভার একটি ট্রাস্টের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেইমতো আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে আরএনআই-এর শংসাপত্র আসে সোমবার বিকালে। কিন্তু নাটকের তখনও বাকি ছিল!
সিপিএম ভুল নামে অবৈধ ভাবে কাগজ চালাচ্ছে, এই মর্মে জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ জমা হয়েছিল সম্প্রতি। তার প্রেক্ষিতেই সোমবার বিকালে ফের ডাকা হয় শুনানি। সিপিএম নেতারা গিয়ে আরএনআই-এর সদ্যপ্রাপ্ত শংসাপত্র পেশ করেন। তখনই দ্রুত বদলায় ঘটনাপ্রবাহ। সিপিএম নেতাদের অভিযোগ, তাঁরা যখন বাইরে বসে, জেলাশাসকের দফতরে রাত ৯টা ২০ মিনিটে ঢোকেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাজীব ভট্টাচার্য। সদর মহকুমার যে এসডিএম সিপিএমের আবেদনপত্র ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেই রাজীব দত্তকে ডেকে পাঠানো হয়। ওই দফতর থেকেই ই-মেল পাঠিয়ে আরএনআই-কে বলা হয়, জেলাশাসকের তরফে আগেকার ছাড়পত্র প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আরএনআই-ও নোটিস দিয়ে ওই একই কারণ দেখিয়ে প্রকাশনার অনুমোদন ফিরিয়ে নেয়।
বিরোধী দলের রাজনৈতিক মতের প্রচার বন্ধ করতে এমন তৎপরতা কেন? বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাজীববাবু মঙ্গলবার বলেন, ‘‘এতে আমাদের কোনও হাত নেই। তবে সিপিএম দীর্ঘ দিন ধরে বেআইনি ভাবে কাগজ চালিয়ে, ভুল খবর দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছিল। সেই যন্ত্রণাটা ছিল। তাই অভিযোগ হয়েছিল।’’ তা হলে ছাড়পত্র দেওয়া হল কী ভাবে, আবার ফেরানোই বা হল কেন? রাজীববাবুর বক্তব্য, ‘‘এটা তো প্রশাসনের ব্যাপার।’’ পশ্চিম ত্রিপুরার জেলাশাসক সন্দীপ মাহাত্মেও বলেন, ‘‘অভিযোগ ছিল। তার প্রেক্ষিতে শুনানি করে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটাই প্রক্রিয়া।’’ আগে ছাড়পত্র পেয়ে আরএনআই শংসাপত্র দিয়ে দিল কী ভাবে? জেলাশাসকের মত, ‘‘এসডিএমের দিক থেকে যে ছাড়পত্র এসেছিল, তাতে কিছু ভুল ছিল। কেউ কোনও চাপ দেয়নি।’’ প্রসঙ্গত, এমন টানাপড়েন যখন চলছে, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের এক আধিকারিক সাংবাদিকদের মেসেজ পাঠিয়ে এত্তেলা করেছিলেন, ‘বেআইনি কাজে’র জন্য সিপিএম মুখপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করার দাবি উঠেছে। তাঁরা যেন খেয়াল রাখেন!
ঘটনার জেরে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতমবাবুর মন্তব্য, ‘‘সংবাদপত্র ও গণতন্ত্রের ইতিহাসে কালো দিন। অন্যায় ভাবে জেলাশাসকের উপরে চাপসৃষ্টি করে ৪০ বছরের কাগজের কণ্ঠরোধ করা হল। কিন্তু লড়াইটা এখানেই শেষ নয়।’’