বিধায়ককে জেলে পাঠাল কোর্ট, বিক্ষোভ, অবরোধ করিমগঞ্জে

শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ করিমগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সিদ্দেক আহমেদকে জেলেই পাঠাল আদালত। এই একই মামলায় তাঁর সঙ্গে জেল হাজতে পাঠানো হল সিদ্দেকের দুই ভাই, আব্দুল শাহিদ ও সাবির আহমেদকে। করিমগঞ্জের এই কংগ্রেস নেতার জেল হেফাজতের খবর ছড়িয়ে পড়তেই তাঁর সমর্থকরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। করিমগঞ্জ শহর ছাড়াও জেলার বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে সিদ্দেকের নিজের এলাকা দক্ষিণ করিমগঞ্জে পথ অবরোধ, বিক্ষোভ, ধর্নায় বসে তাঁর সমর্থকরা। আদালত চত্বরে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশের লাঠির মুখে সমর্থকদের বাধা শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। ৩ বারের বিধায়ককে করিমগঞ্জের জেলা কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ।

Advertisement

শীর্ষেন্দু শী

করিমগঞ্জ শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০৩:৫৫
Share:

পুলিশি ঘেরাটোপে জেল হাজতের পথে সিদ্দেক আহমেদ। বৃহস্পতিবার করিমগঞ্জ আদালতে।

শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ করিমগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সিদ্দেক আহমেদকে জেলেই পাঠাল আদালত।

Advertisement

এই একই মামলায় তাঁর সঙ্গে জেল হাজতে পাঠানো হল সিদ্দেকের দুই ভাই, আব্দুল শাহিদ ও সাবির আহমেদকে। করিমগঞ্জের এই কংগ্রেস নেতার জেল হেফাজতের খবর ছড়িয়ে পড়তেই তাঁর সমর্থকরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। করিমগঞ্জ শহর ছাড়াও জেলার বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে সিদ্দেকের নিজের এলাকা দক্ষিণ করিমগঞ্জে পথ অবরোধ, বিক্ষোভ, ধর্নায় বসে তাঁর সমর্থকরা। আদালত চত্বরে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশের লাঠির মুখে সমর্থকদের বাধা শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। ৩ বারের বিধায়ককে করিমগঞ্জের জেলা কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ।

এই ঘটনার শুরু ২০১১ সালে। সে সময় সিদ্দেক অসম বিধানসভায় শাসক দলের পরিষদীয় সচিব। তখন সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন তহবিলে দুর্নীতির এক অভিযোগের তদন্ত করতে আসে কেন্দ্রের একটি দল। তাদের কাছে বক্তব্য ও নথি পেশ করতে গিয়ে সিদ্দেক ও তাঁর সমর্থকদের হাতে প্রহৃত হন রেজাউল করিম নামে এক যুবক। তিনিও কংগ্রেস কর্মী। রেজাউল সিদ্দেক, তাঁর ভাই ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। পরবর্তী ক্ষেত্রে নিলামবাজার থানা আদালতে যে চার্জশিট পেশ করে, তাতে সিদ্দেকের নাম বাদ দেওয়া হয়।

Advertisement

রেজাউল আবার আদালতে অভিযোগ আনেন। এর পরেই করিমগঞ্জের অ্যাডিশনাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (এসিজেএম) এস এস এ রহমান সিদ্দেককে সমন পাঠান। পর পর তিন বার সেই সমনকে উপেক্ষা করেন সিদ্দেক। এর পর আদালত তাঁর বিরুদ্ধে প্রথমে গ্রেফতারি পরোয়ানা, পরে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং সব শেষে রোভিং ওয়ারেন্ট জারি করে। এর পরেও পুলিশ সিদ্দেককে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। ক্ষুব্ধ বিচারক যেখান থেকে হোক দক্ষিণ করিমগঞ্জের এই ‘হাই প্রোফাইল’ বিধায়ককে আদালতে হাজির কারনোর জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন।

সেই নির্দেশ কার্যকর করতে করিমগঞ্জ পুলিশের দল গুয়াহাটিতে বিধায়কের সরকারি আবাসে হাজির হন। তখন তিনি রাজধানীরই একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। পুলিশ ফিরে এসে আদালতে সেই রিপোর্ট দেয়। এর পর বিচারক ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট চিকিত্সককে ডেকে পাঠান। তাঁদের বক্তব্যে অসন্তুষ্ট আদালত চিকিত্সকের রেজিস্ট্রেশন ও হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশ দেন। এর পরেই সিদ্দেক গৌহাটি হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন করেন। হাইকোর্ট আগাম জামিন মঞ্জুর না করে তাঁকে ৩০ এপ্রিল এসিজেএম আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। তত দিন নিম্ন আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানার উপরেও স্থগিতাদেশ জারি হয়।


সিদ্দেক আহমেদের হাজিরা নিয়ে করিমগঞ্জ আদালতে পুলিশ-প্রহরা। বৃহস্পতিবার।

আজ, সিদ্দেক আহমেদ আদালতে হাজির হন। তার আগে গুয়াহাটিতে এক দফা ও করিমগঞ্জে দু’বার সাংবাদিকদের কাছে মামলা সম্পর্কে নানা মন্তব্য করেন। এমনকী তাঁকে চক্রান্ত করে ফাঁসানো হচ্ছে বলেও সিদ্দেক মন্তব্য করেন। তাঁর কথায় কটাক্ষ ছিল আদালতের প্রতিও।

পরে আদালতে হাজিরা দিয়ে তিনি জামিনের আবেদন করেন। এ নিয়ে সরকার পক্ষের আইনজীবী এবং বিধায়কের আইনজীবীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে। সরকার পক্ষের আইনজীবী কবীর আহমেদ চৌধুরী জামিনের ঘোর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘‘সিদ্দেক আহমেদের বিরুদ্ধে আগেও বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছিল। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে তা থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেছিলেন। আজকেও যদি আদালত তাঁকে জামিন দেয়, তা হলে সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়বে।’’ করিমগঞ্জের এসিজেএম দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে জামিন খারিজ করেন। কারণ আদালত মনে করে, মামলা বিচারাধীন থাকাকালীন সংবাদমাধ্যমে সিদ্দেক আহমেদ কিছু মন্তব্য করে আদালত অবমাননা করেছেন। ফলে জামিন না দিয়ে তাঁকে সাত দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। একই সঙ্গে সিদ্দেকের দুই ভাই আব্দুল শাহিদ ও সাবির আহমেদকেও সাত দিনের জেল হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।

জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পরই সিদ্দেক-সমর্থকরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাঁকে গ্রেফতার করে করিমগঞ্জ জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা পুলিশের উপরে চড়াও হয়। হাতাহাতি সংঘর্ষের দিকে যেতেই বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন করিমগঞ্জের সদর ডিএসপি। ডাকা হয় আধা-সামরিক বাহিনীকেও। বিধায়কের সমর্থকরা স্লোগান দিতে শুরু করলে আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা লাঠিচার্জ করে তাদের আদালত চত্বরের বাইরে বের করে দেয়। এই লাঠি চালনায় ১৭ জন বিক্ষোভকারী জখম হয়। তাদের করিমগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। এর পর কড়া পুলিশি বেষ্টনীতে সিদ্দেককে জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতের দিকে তিনি শরীর খারাপের কথা বলায় তাঁকে জেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

সিদ্দেককে জেলে পাঠানোর প্রতিবাদে করিমগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় তাঁর সমর্থকরা জাতীয় সড়ক অবরোধ করে। তাঁর নিজের আসন, দক্ষিণ করিমগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অবরোধের পাশাপাশি পাথারকান্দির আছিমগঞ্জেও পথ অবরোধ করা হয়। বিধায়কের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চক্রান্ত চলছে বলেও অভিযোগ ওঠে। উল্লেখ্য, গত বছর হিমন্ত বিশ্বশর্মার নেতৃত্বে মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের বিরুদ্ধে বিধায়কদের একাংশের বিদ্রোহেও সামিল ছিলেন সিদ্দেক। সে সময়েই তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন।

মূল অভিযোগকারী রেজাউল করিম আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও তাঁর উপরে বিধায়কের সমর্থকরা হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি নিরাপত্তা চেয়েছেন। পরে সরকারি আইনজীবী বলেন, ‘‘রেজাউলকে মারধরের ঘটনায় সিদ্দেক আহমেদ যে জড়িত রয়েছেন, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।’’ শাসক দলের জনপ্রতিনিধি হওয়াতেই পুলিশ তাঁকে মামলার চার্জশিট থেকে রেহাই দিয়েছে বলেও সরকারি আইনজীবীর অভিযোগ। তিনি মনে করেন, ‘‘বিধায়ককে কারাগারে পাঠিয়ে আদালত তার নিরপেক্ষতাই প্রমাণ করেছে।’’ অন্য দিকে, এই রায়ের পরেই বিধায়কের আইনজীবীরা জেলা দায়রা জজের আদালতে জামিনের আবেদন করেন। কিন্তু সেই আদালতও জামিন মঞ্জুর করেনি। ২ মে মামলার রিপোর্ট তলব করেছে দায়রা আদালত।

— নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement