প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তাঁর বিদেশ সফরের বহর নিয়ে কটাক্ষ কম হয়নি। আমেরিকা-ইউরোপ-এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া— আন্টার্কটিকা বাদ দিলে সর্বত্রই গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। বহু দেশে একাধিক বার, বিশেষত পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে। এমনকী দেশে সংসদ চলাকালীনও বিদেশ সফর করেছেন তিনি। বিরোধীদের বিদ্রুপ আর কটাক্ষের জবাব দিতে গিয়ে তাঁর দল তথা সরকার বলেছে, ওই সব দেশের সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে বিনিয়োগ আনা তো বটেই, প্রবাসী এবং অনাবাসী ভারতীয়দের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতি মজবুত করাই এই সব সফরের অন্যতম লক্ষ্য।
সেই লক্ষ্যের কতটা পূরণ হয়েছে?
সরকারের চার বছর পূর্তির মুখে দাঁড়িয়ে এই সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে বিদেশ মন্ত্রক রাজ্যসভায় লিখিত ভাবে স্বীকার করে নিল, গত তিনটি আর্থিক বছরে বিদেশি মুদ্রা রোজগারের ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে। শতাংশের হিসেবে তা ৮.৯৪ শতাংশ। সরকারেরই হিসেব অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ সালে বিদেশি মুদ্রা আমদানি হয়েছিল ৬৯০০.৮১৯ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৬-১৭ সালে এই অঙ্কটা কমে দাঁড়িয়েছে ৬১০০.২৯৬ কোটি মার্কিন ডলারে। সূত্রের খবর, চলতি আর্থিক বছরেও এই পরিমাণ উৎসাহব্যঞ্জক নয়। বরং কমেরই দিকে।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে কাতার, সৌদি আরব, জর্ডন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো দেশগুলির সঙ্গে দৌত্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন মোদী। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই দেশগুলির থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা আসে। এখানে কর্মরত ভারতীয় নাগরিক এবং বংশোদ্ভূতদের সংখ্যাও বিপুল। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্যের পরে প্রশ্ন উঠছে, এত বার সফরের পরেও কেন এই অধঃপতন? এই রাষ্ট্রগুলিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বারবার দেখা গিয়েছে অনাবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে বৈঠক করতে। আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশে মহা আড়ম্বরে সভাও করেছেন মোদী। বিজেপি-র বিভিন্ন শাখা সেগুলির বিপুল প্রচারও করেছে।
তা হলে কী হল?
প্রশ্নের জবাবে বিদেশ প্রতিমন্ত্রী ভি কে সিংহ বলেন, ‘‘উপসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক মন্দা, কর্মসংকোচন, অপরিশোধিত তেলের দাম হু হু করে পড়ে যাওয়া— সব মিলিয়েই বিদেশি মুদ্রা আমদানির পরিমাণ কমেছে।’’ পাশাপাশি বিদেশ প্রতিমন্ত্রীর দাবি, ‘‘পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ভারত যোগাযোগ রেখে চলেছে। বাহরাইন, কুয়েত, ওমান-এর মতো দেশগুলির সঙ্গে আমরা শ্রম এবং মানবসম্পদ সমন্বয় নিয়ে বিভিন্ন চুক্তিও করেছি। ভারতীয় কর্মীদের বিদেশের মাটিতে যাতে কোনও সমস্যার মুখে পড়তে না হয় এবং তাদের স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সে জন্য সব রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে আমাদের সরকার।’’
আরও পড়ুন: শৌচালয় হলেই ফিরবেন নববধূ
বিদেশ প্রতিমন্ত্রীর এই সব যুক্তি অবশ্য মানছেন না অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, বিদেশি মুদ্রার রোজগারে টান পড়া অর্থনীতির পক্ষে চিন্তার। এর ফলে দেশের আমদানি-রফতানি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সরকারি সূত্রে স্বীকার করা হচ্ছে, ভারতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমার অন্যতম কারণ, বৈদেশিক মুদ্রার উপর অতিরিক্ত কর চাপানোর প্রবণতা। তা ছাড়া নিয়োগের ব্যাপারে অনেক দেশে সংকোচন-নীতিও বড় প্রভাব ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমলে প্রথমেই চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রা লেনদেনে ঘাটতি দেখা দেবে। যে ঘাটতি থেকে বাঁচতে অর্থমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংহ আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, সেই সঙ্কট ফিরতে পারে কিনা, সেই প্রশ্নও উঠছে। অনেকের মতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য দেশের কাজের বাজারেও।