শনিবার দেশের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল ৩ লক্ষ। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
১১০ দিন, ১৫ দিন, ১০ দিন— শূন্য থেকে ১ লক্ষ, ১ থেকে ২ লক্ষ এবং ২ থেকে ৩ লক্ষ। দেশের করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির গ্রাফ এমনটাই। শনিবার দেশের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল ৩ লক্ষ। আক্রান্তের এই পরিসংখ্যান দেখে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে প্রশাসন থেকে বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসক এবং অবশ্যই আম জনতার। আরও আশঙ্কার যে, ২ থেকে ৩ লক্ষে পৌঁছনোর বেশির ভাগ সময়টাই দেশে ছিল লকডাউন। কিন্তু এখন লোকাল ট্রেন, মেট্রো এবং আন্তর্জাতিক উড়ান বাদ দিলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় পুরোটাই চালু হয়ে গিয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত যে কোথায় গিয়ে থামবে আক্রান্তের সংখ্যা, তা ভেবেই ঘুম ছুটেছে সবার।
দেশে রোজদিন সংক্রমণের গতি বৃদ্ধি জাগাচ্ছে নতুন শঙ্কা। সংক্রমণ বৃদ্ধিতে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে নতুন রেকর্ড। শনিবারও তাঁর অন্যথা হল না। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় ১১ হাজার ৪৫৮ জন নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় এত সংখ্যক মানুষ এর আগে আক্রান্ত হননি। এই বৃদ্ধির জেরে দেশে মোট কোভিডে আক্রান্ত হলেন তিন লক্ষ ৮ হাজার ৯৯৩ জন। পাশাপাশি মহারাষ্ট্রেও মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষ পার হল।
করোনার হানায় গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে মৃত্যু হয়েছে ৩৮৬ জনের। এ নিয়ে মোট আট হাজার ৮৮৪ জন মারা গেলেন করোনার কারণে। এর মধ্যে মহারাষ্ট্রেই মৃত্যু হয়েছে তিন হাজার ৭১৭ জনের। গুজরাতে মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ২১৪ জনের। বিগত কয়েক দিনে দিল্লিতেও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। রাজধানীতে এখনও অবধি এক হাজার ২১৪ জন মারা গিয়েছেন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে। মোট মৃত্যুর নিরিখে দেশের চতুর্থ স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে, এ রাজ্যে মোট ৪৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া শতাধিক মৃত্যুর তালিকায় রয়েছে মধ্যপ্রদেশ (৪৪০), তামিলনাড়ু (৩৬৭), উত্তরপ্রদেশ (৩৬৫), রাজস্থান (২৭২) ও তেলঙ্গানা (১৭৪)।
দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ৩০ জানুয়ারি, কেরলে। চিনের উহান থেকে ফিরেছিলেন তিনি। তার পর কেটে গিয়েছে চার মাসেরও বেশি। করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত নয় এবং শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমেই মূলত ছড়ায়। এক থেকে ২, ২ থেকে ৪, ৪ থেকে ১৬ এই রকম হারে বাড়তে থাকে। আক্রান্তের সংখ্যা যত বাড়ে, তাঁদের সংস্পর্শে আসা মানুষজনের মধ্যেও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে অত্যন্ত বেশি। সেই দিক থেকে দেখলে ১ থেকে বেড়ে ১ লক্ষ হওয়ার সময়ের ব্যবধানের সঙ্গে ২ লক্ষ থেকে বেড়ে ৩ লক্ষ হওয়ার সময়সীমার কার্যত তুলনা করা চলে না। কিন্তু তবু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা বুঝতে এটা সাহায্য করে। তাই আক্রান্তের সংখ্যা ১ লক্ষের গণ্ডিতে ভাগ করে দেখা যাচ্ছে ১ থেকে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ১১০ দিন। ১ লাখ থেকে ২ লাখে পৌঁছতে সেই সময় লেগেছে মাত্র ১৫ দিন। আর শেষ ২ লাখ থেকে ৩ লাখে পৌঁছতে সময় লাগল মাত্র ১০ দিন। প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই হারে বাড়তে থাকলে ৪ লক্ষে পৌঁছতে আরও কম সময় লাগবে। ফলে উদ্বেগ আরও জাঁকিয়ে বসছে সব মহলে।
উদ্বেগ ঠিক কতটা? ভাইরাস বিশেষজ্ঞ দিলীপ চক্রবর্তীর মতে, “কোনও ভাইরাস তার ক্ষমতা তখনই হারাতে শুরু করে যখন সে আর রোগ ছড়ানোর শরীর পায় না। মানে, শৃঙ্খল ভেঙে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে শুধু বাস-ট্রেন-যানবাহন-অফিস স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে একটা 'ছেলেখেলার' লকডাউন হল। সব বন্ধ, কিন্তু বাজারে ভিড়, দোকানে কোনও সামাজিক দুরত্ব নেই। ছুটি কাটানোর মতো করে লকডাউন কাটালাম আমরা। তার খেসারত আমরা দিয়েই চলেছি। সরকারও এই সময় কিট তৈরি করতে পারল না। সব জায়গায় লকডাউন করে আর্থিক ভাবেও পিছিয়ে গেলাম আমরা। সব মিলিয়ে আমরা শৃঙ্খল ভাঙতে পারলাম না। যে সব দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে তারা কিন্তু এই শৃঙ্খল ভেঙেই তা পেরেছে।”
তাঁর দাবি, “এই ভাইরাসের চরিত্র এখনও খুব ভাল জানা যায়নি। তবে যেটুকু জানা গিয়েছে তাতে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, এই ভাইরাস খুব সহজে যাবে না। কড়া হাতেই প্রতিরোধ করতে হবে। এর প্রোটিন স্পাইকগুলি দুর্বল আড্যাপ্টার পেলেই চেপে ধরে। তাই বিপুল টেস্ট, উপসর্গবিহীন রোগীদেরও চিহ্নিত করা ও তাদের আলাদা করে ফেলার মধ্যেই সাফল্য লুকিয়ে আছে। মাত্র ৬ মাসের একটা নতুন ভাইরাসকে দেখে তা কত দ্রুত চলে যাবে বা আদৌ নিজে থেকে যাবে নাকি টিকা বা ওষুধ লাগবে, এগুলো বলার সময় এখনও আসেনি। শুধু মাস্ক আর সাবানের ফ্যাট দিয়ে এর প্রোটিন স্পাইককে গলিয়ে মেরে দেওয়াই এখন উপায়। এ সব না মানলে অগস্ট পর্যন্ত এই সংক্রমণ চলবে। তার পর হয়তো ধীরে ধীরে কমবে মানুষের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাড়ার ফলে। তবে হার্ড ইমিউনিটি আনার জন্য এত বড় দেশে রোগ ছড়াতে দিলে তা কিন্তু অনেক প্রাণ ও অনেক সংক্রমণের বিনিময়ে আনতে হবে, যা খুব দুর্ভাগ্যের।”
উদ্বেগের কারণ রয়েছে পাঁচ দিনের মুভিং অ্যাভারেজ বা চলন্ত গড়েও। কোনও একটি চলমান বিষয়ের কোনও একটি দিনের পরিসংখ্যান তার আগের দু’দিন এবং দু’দিন পরের হিসেবের গড়কেই পাঁচ দিনের চলন্ত গড় বলা হয়। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমান তালে বেড়েছে এই চলন্ত গড়ও। মার্চের ৪ তারিখে এই গড় ছিল ৬। অর্থাৎ ওই পাঁচ দিনে গড়ে ৬ জন মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন। ৩১ মার্চে এসে সেই গড় হয়ে যায় ২৩০। আবার এক মাস পর ৩০ এপ্রিল এই গড় ছিল ১ হাজার ৮৭৯। ৩১ মে পাঁচ দিনের চলন্ত গড় পৌঁছে গিয়েছে ৮ হাজার ৭৫-এ। আর শেষ ১০ জুন এই গড় ছিল ১০ হাজার ১৮১।
আরও পড়ুন: বাড়ছে করোনা-সংক্রমণ, দু’মাসেই কি ভারত ছোঁবে আমেরিকাকে?
কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা শূন্য থেকে ৩ লাখ পর্যন্ত পৌঁছনোর পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। এর মধ্যে চার দফা লকডাউন হয়েছে। কিন্তু এখন প্রায় সব রকম অর্থনৈতিক কাজকর্ম চালু হয়ে গিয়েছে। খুলেছে সরকারি-বেসরকারি অফিস, যানবাহন চালু হয়েছে। রাস্তায় মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। ফলে অনেকের মনেই প্রশ্ন, প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কি বাড়তেই থাকবে? বাড়লেও আরও কত দিন বাড়বে এবং কখন থেকে কমতে শুরু করবে? শেষ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা কত হবে? পরিভাষায় যাকে বলা হচ্ছে শিখরে পৌঁছনো। সম্প্রতি দিল্লির এমস হাসপাতালের ডিরেক্টর রণদীপ গুলেরিয়া বলেছেন, আরও দু’-আড়াই মাসে ভারত করোনা সংক্রমণের শিখরে বা সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছবে। তার পরে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে পারে। কিন্তু এখনকার হিসেবে যদি বাড়তে তাকে, তা হলে আক্রান্তের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। ভাবতেও শিউরে উঠছেন বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞরা।
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। চলন্ত গড় কী এবং কেন তা লেখার শেষে আলাদা করে বলা হয়েছে।)
এর মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েই চলেছে মহারাষ্ট্র। গোড়া থেকেই এই রাজ্য কার্যত সংক্রমণের শীর্ষে ছিল। তার পর সময় যত গড়িয়েছে, এই রাজ্য নিয়ে সারা দেশের শঙ্কা বেড়েছে। দেশের মোট আক্রান্তের প্রায় এক তৃতীয়াংশই এই রাজ্য থেকে। সে রাজ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন তিন হাজার ৪৯৩ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা হল এক লক্ষ এক হাজার ১৪১ জন। মৃতের সংখ্যাতেও শীর্ষে সেই মহারাষ্ট্র।
আক্রান্তের নিরিখে মহারাষ্ট্রের পরই রয়েছে তামিলনাড়ু সেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা শনিবার ৪০ হাজার পেরলো। এর পরই রয়েছে রাজধানী দিল্লি। রোজদিন সেখানে লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সেখানে এখনও অবধি ৩৬ হাজার ৮২৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন কোভিডে। এর পর রয়েছে ক্রমান্বয়ে রয়েছে গুজরাত (২২,৫২৭), উত্তরপ্রদেশ (১২,৬১৬), রাজস্থান (১২,০৬৮), মধ্যপ্রদেশ (১০,৪৪৩), পশ্চিমবঙ্গ (১০,২৪৪)।
তবে এর মধ্যেও স্বস্তির খবরও রয়েছে একাধিক। প্রথমত, ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে ভারতে মৃত্যুর হার অনেক কম। সেটা গোড়া থেকেই ছিল। কেন কম, সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু তাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলেছে। আবার জনসংখ্যা অনুযায়ী সংক্রমণেও ভারত ভাল জায়গায় রয়েছে। সারা বিশ্বে জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হলেও সংক্রমণের নিরিখে এখনও ভারত চতুর্থ স্থানে। ভারতের উপরে রয়েছে রাশিয়া, ব্রাজিল এবং আমেরিকা। কিন্তু ব্রাজিলের সঙ্গে ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যার পার্থক্য প্রায় ২ লক্ষ।
আরও পড়ুন: করোনা বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা পূর্ব-ভারতে
আবার সুস্থ হয়ে ওঠার হিসেবও স্বস্তি দিয়েছে ভারতবাসীকে। এখন দেশে সুস্থ হয়ে করোনা রোগীর সংখ্যা সক্রিয় করোনা আক্রান্তের (মোট আক্রান্ত থেকে মৃত ও সুস্থ হয়ে ওঠা বাদ দিয়ে) সংখ্যার চেয়ে বেশি। আবার সুস্থ হওয়ার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে মোট আক্রান্তের প্রায় অর্ধেকের কাছে চলে এসেছে। অর্থাৎ আক্রান্তের সংখ্যা এবং সুস্থ হয়ে ওঠার সংখ্যার ব্যবধান ক্রমেই কমছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কয়েক দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা অর্ধেকের বেশি হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন সাত হাজার ১৩৫ জন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর এখনও অবধি সুস্থ হলেন এক লক্ষ ৫৪ হাজার ৩৩০ জন।
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। চলন্ত গড় কী এবং কেন তা লেখার শেষে আলাদা করে বলা হয়েছে।)
(চলন্ত গড় বা মুভিং অ্যাভারেজ কী: একটি নির্দিষ্ট দিনে পাঁচ দিনের চলন্ত গড় হল— সেই দিনের সংখ্যা, তার আগের দু’দিনের সংখ্যা এবং তার পরের দু’দিনের সংখ্যার গড়। উদাহরণ হিসেবে— দৈনিক নতুন করোনা সংক্রমণের লেখচিত্রে ১৮ মে-র তথ্য দেখা যেতে পারে। সে দিনের মুভিং অ্যাভারেজ ছিল ৪৯৫৬। কিন্তু সে দিন নতুন আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ৫২৬৯। তার আগের দু’দিন ছিল ৩৯৭০ এবং ৪৯৮৭। পরের দুদিনের সংখ্যা ছিল ৪৯৪৩ এবং ৫৬১১। ১৬ থেকে ২০ মে, এই পাঁচ দিনের গড় হল ৪৯৫৬, যা ১৮ মে-র চলন্ত গড়। ঠিক একই ভাবে ১৯ মে-র চলন্ত গড় হল ১৭ থেকে ২১ মে-র আক্রান্তের সংখ্যার গড়। পরিসংখ্যানবিদ্যায় দীর্ঘমেয়াদি গতিপথ সহজ ভাবে বোঝার জন্য এবং স্বল্পমেয়াদি বড় বিচ্যুতি এড়াতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়)