প্রতীকী ছবি
সোমবার থেকে দেশ জুড়ে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে লকডাউন শিথিল হতে চলেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, আসল লড়াই শুরু তখনই। দেশে ‘এপিডেমিক কার্ভ’ বা মহামারির লেখচিত্র সবে ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে অফিস, রাস্তাঘাট, কলকারখানায় লোকজনের যাতায়াত শুরু হলে ছবিটা ঠিক কী দাঁড়াবে, আপাতত সেটাই উদ্বেগে রেখেছে তাঁদের।
কারণ, মহামারির খবর প্রকাশ্যে আসার তিন মাসের মাথায় কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই রোগের উৎসকেন্দ্র চিনকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারত। ১১ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সাত দিনে, প্রতিদিন গড়ে চিনের সংক্রমণের থেকে প্রায় আট গুণ বেশি হারে ভারতে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এই সাত দিনে কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা যেখানে চিনে বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৮০ জন, অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ১১১ জন, সেখানে ভারতে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৯৪০ জন যা প্রতিদিন গড়ে ৮৪৮ জন করে! এপিডিমিয়োলজিস্টরা বলছেন, সংক্রমণের যে পর্যায়ে ভারত বর্তমানে রয়েছে, সেখানে এই হার স্বাভাবিক। বরং তা আরও বাড়ার আশঙ্কা। তাই আরও সতর্ক থাকা দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তথ্য বলছে, মোট সংক্রমিত রোগীর সংখ্যার নিরিখে বিশ্বের ২১০টি দেশ-অঞ্চলের মধ্যে শুক্রবার পর্যন্ত ভারতের স্থান ছিল ১৭।
‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এর ডিরেক্টর-প্রফেসর মধুমিতা দোবে জানাচ্ছেন, এই সময়ে ভারত করোনা সংক্রমণের প্রথম পর্বের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ‘নন-ইমিউন’ বা কোভিড ১৯-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই, এমন লোকেদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। আর চিন-সহ কিছু কিছু দেশে যেখানে আগে সংক্রমণ হয়ে কমে গিয়েছিল, সেখানে এই মুহূর্তে সংক্রমণের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। সেই সব দেশের লোকেদের কিছুটা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। ফলে সংক্রমণের হারের মধ্যেও তফাত হবে। তাঁর কথায়, ‘‘লকডাউন শিথিল হওয়া মানেই সংক্রমণ চলে গেল এমন নয়। লকডাউন সংক্রমণ ছড়ানো কমায়। তাতে স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে চাপ কমে। ক্রিটিক্যাল রোগীরা যথাযথ পরিষেবা পান। এখন যে নিয়মগুলি পালন করা হচ্ছে, ধাপে ধাপে লকডাউন উঠতে শুরু করলে তখনও বেশ কিছু দিন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, এক জায়গায় জমায়েত না হওয়া, দূরত্ব-বিধি মেনে চলার মতো নিয়মগুলি পালন করতে হবে।’’
আরও পড়ুন: রাহুলের ফেরার জল্পনা বাড়াল সনিয়ার কমিটি
গত বছরই মহামারি সংক্রমণ প্রতিরোধে কোন দেশ কতটা প্রস্তুত, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কেমন, সংক্রমণ-বিপদের মাত্রা কোন দেশে বেশি-সহ মোট ছ’টি বিষয়ের নিরিখে তৈরি হয়েছিল ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য নিরাপত্তা’ সূচক (গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি, সংক্ষেপে জিএইচএস ইনডেক্স)। সেখানে প্রথম সারিতে থাকা আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ একাধিক দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন করোনা-হানায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। যা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ওই সূচকের ফলাফল নিয়েই। যদিও জিএইচএস সূচক স্পষ্ট বলেছিল, হু-র চুক্তিবদ্ধ ১৯৫টি দেশের মধ্যে কোনও দেশই মহামারি নিয়ন্ত্রণে নিরাপদ নয়। সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রস্তুতির নিরিখে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে উন্নত দেশগুলির গড় ‘স্কোর’ এসেছিল ৫১.৯! আর সেই সূচকে ভারতের স্থান ছিল ৫৭ নম্বরে। ওই সূচক তৈরির ক্ষেত্রে পরামর্শ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য, পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত, ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এর বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক ইন্দিরা নাথ বলেন, ‘‘জিএইচএস সূচকের মতো ভারতের কোন রাজ্য মহামারি সংক্রমণে কতটা প্রস্তুত, সেই সংক্রান্ত একটি জাতীয় সূচক থাকলে এই পরিস্থিতিতে ভাল হত। সে ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অবস্থা, সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণ-সহ সমস্ত ক্ষেত্রের স্পষ্ট চিত্র রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে থাকত। তাতে সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই করাটা তুলনায় সুবিধাজনক হত।’’
জনস্বাস্থ্য-বিজ্ঞানী ও ‘সেন্টার ফর সাসটেনেবল হেলথ ইনোভেশনস’-এর অধিকর্তা প্রিয়া বালসুব্রহ্মণ্যমের কথায়, ‘‘লকডাউন শিথিল হওয়ার পরে অফিস, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প কারখানা কর্তৃপক্ষকে তাঁদের শ্রমিকদের জন্য মাস্ক, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রান্তিক মানুষকে এটাও বোঝানো প্রয়োজন, জীবিকার স্বার্থেই সুস্থ থাকতে নিয়ম মানতে হবে তাঁদের। কারণ, অসুস্থ হয়ে পড়লে কাজ করা যাবে না।’’ এপিডিমিয়োলজিস্ট কুণাল মজুমদার বলেন, ‘‘লকডাউন চললে দেশের বড় অংশের মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিজনিত রোগ হত। তাই লকডাউন শিথিলের পরেও পরীক্ষা করা এবং সংক্রমণের ক্লাস্টারগুলি চিহ্নিত করে সেখানে নজরদারি চালানো প্রয়োজন। কারণ, এপিডেমিক কার্ভ ঊর্ধ্বমুখী থাকলে সংক্রমিত রোগী বাড়বে। এ ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া এবং নিয়ম মানা ছাড়া অন্য উপায় নেই।’’
আরও পড়ুন: বদলাবে কাজের ধরন, বলছেন শিল্পপতিরাও