Coronavirus Lockdown

ক্ষোভ-রাগ আর প্রশ্নই সম্বল পরিযায়ী শ্রমিকদের

করোনা-পর্বে ভিন্‌ রাজ্যে কাজে গিয়ে আটকে পড়া এবং ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকেরই রাগ ‘সরকারের’ উপরে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২০ ০৫:২৮
Share:

অসুস্থ পরিজনকে কোলে নিয়ে স্টেশনের পথে এক পরিযায়ী শ্রমিক। শনিবার দানাপুরে। ছবি: পিটিআই।

কাজ নেই। টাকা শেষ। জুটছে না খাবার। অথচ, বাড়ি থেকে বহু দূরে আটকে থাকতে হয়েছে, হচ্ছে। তাই সম্বল বলতে ক্ষোভ, রাগ আর প্রশ্ন।

Advertisement

করোনা-পর্বে ভিন্‌ রাজ্যে কাজে গিয়ে আটকে পড়া এবং ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকেরই রাগ ‘সরকারের’ উপরে। সে কেন্দ্রেই হোক, বা রাজ্য। বা দু’পক্ষের উপরেই।

নবি মুম্বই থেকে ২৩ দিন ধরে সাইকেল চালিয়ে সদ্য বাড়ি ফিরেছেন হুগলির হরিপালের বরুণ মিত্র। ছাপাখানার ওই শ্রমিক বলছেন, ‘‘লকডাউন ঘোষণার আগে শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার জন্য কিছুটা সময় দিতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।’’ খানাকুলের শঙ্কর অধিকারী পঞ্জাবের অমৃতসরে গয়না তৈরির কাজ করতেন। বহু দিন সেখানে আটকে থাকার পরে, তিনিও বহু কষ্টে ফিরেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল, ট্রেনে করে আগে অন্য রাজ্যে আটকে থাকা গরিবদের বাড়ি ফিরিয়ে, তার পরে লকডাউন করা।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: পরিযায়ীদের কাজের জায়গায় ফেরাতে ট্রেন

হায়দরাবাদে দিনমজুরি করতে যাওয়া পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার সাহেব আলি খান, মোশারফ খানেরা সদ্য মাথাপিছু পাঁচ হাজার টাকারও বেশি বাস ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তাঁরা বলছেন, ‘‘টানা লকডাউন ঘোষণা করার কয়েক দিন আগে থেকে কেন্দ্র সরকার যদি ব্যাপারটার ইঙ্গিত দিত, তা হলে আধপেটা খেয়ে সে টাকায় বাস ভাড়া দিয়ে ঘরে ফিরতে হত না।’’

আরও পড়ুন: আনলকডাউন শুরু হচ্ছে কাল, তবে কন্টেনমেন্ট জ়োন লকডাউনেই

তবে সব তোপ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে নয়। শ্রমিকেরা কাঠগড়ায় তুলছেন রাজ্য সরকারকেও। ছত্তীসগঢ়ের ভিলাইয়ে অনলাইন পোশাক কেনাবেচার সংস্থার ছয় তরুণ লকডাউনে আটকে পড়েছিলেন। ছত্তীসগঢ় পুলিশের সহযোগিতায় লরিতে তাঁদের ওড়িশা পর্যন্ত পাঠানো হয়। পরে বার কয়েক লরি বদলে তাঁরা ঝাড়গ্রামের লোধাশুলিতে পৌঁছন। তাঁদের অভিযোগ, রাতে আশ্রয় ও খাবারের জন্য ঝাড়গ্রাম থানার সহযোগিতা চাইতে গেলে, পুলিশ ‘দুর্ব্যবহার’ করে। শেষে স্থানীয়দের অর্থসাহায্যে গাড়ি ভাড়া করে পূর্ব বর্ধমান ও নদিয়ার বাড়িতে ফিরেছেন তাঁরা। দলে থাকা পূর্ব বর্ধমানের নাদনঘাটের অভিজিৎ দেবনাথ, নদিয়ার রানাঘাটের সুকান্ত বর্মনেরা বলেন, ‘‘ছত্তীসগঢ়, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসনের থেকে কিছুটা মানবিক সাহায্য পেয়েছি। অথচ, ঝাড়গ্রামে পৌঁছে জাতীয় সড়কের ধারে শুয়ে রাত কাটাতে হয়েছে। জঙ্গলমহলে আমাদের খুব তিক্ত অভিজ্ঞতা হল।’’

রাজ্য প্রশাসন দাবি করেছে, সমস্যার কথা জানতে পারলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নবান্নের ‘কন্ট্রোল রুম’-এ এখন ফোনের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬০টি করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও বহু মানুষ একসঙ্গে চেষ্টা করায়, ফোনের লাইন পেতে সময় লাগছে। এক বার ফোন না পেয়ে কিছু সময় অন্তর কয়েক বার ফোন করার চেষ্টা করলেই সংযোগস্থাপন সম্ভব। তবে ভিন্‌-রাজ্যে আটকে পড়া শ্রমিকদের প্রশ্ন, ‘‘টাকার অভাবে যেখানে খাওয়া জুটছে না ভাল করে, সেখানে কাঁহাতক দিন-রাত ফোনের পিছনে পড়ে থাকা যায়!’’

ঘরে ফেরার ট্রেন চালু করার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাস, খাবারের ব্যবস্থা করে বাড়ি ফেরানোয় সাহায্য করায় রাজ্য সরকারের প্রশংসা করেছেন কিছু পরিযায়ী। কিন্তু তা কার্যত ঢাকা পড়েছে ঘরমুখী ট্রেনের ‘অপ্রতুলতা’, ট্রেনে খাবারের ‘মান’, জলের ‘অভাবের’ মতো সমস্যা, ট্রেন থামা নিয়ে রেল ও রাজ্যের মধ্যে ‘সমন্বয়ের অভাব’, বৈধ কাগজপত্র থাকলেও রাজ্যের বিভিন্ন সীমানায় পুলিশি-হেনস্থার মতো নানা ধরনের অভিযোগে। এলাকায় ফেরার পরে স্থানীয়েরা আপত্তি করলে পুলিশ-প্রশাসন ঘরে থাকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না, সরকারি ‘কোয়রান্টিন’-এর ‘দুর্দশা’— শোনা যাচ্ছে এমন সব অভিযোগও।

‘‘না খেয়ে, হেঁটে কী ভাবে যে ঘরে ফিরলাম তা শুধু আমরাই জানি। কেউ নজর দেয়নি। না কেন্দ্র সরকার, না রাজ্য’’— দিল্লি থেকে ফিরে এমনই বলছেন উত্তর দিনাজপুরের করণদিঘির রহমত আলি, সুনির্মল বর্মণেরা। বীরভূমের মুরারই ২ ব্লকের নির্মাণ শ্রমিক পলাশ মাল কেরলে আটকে ছিলেন। বাড়ি ফেরার বাস ভাড়ার টাকা তাঁর বাবা ধার করে পাঠান পলাশকে। পলাশের ক্ষোভ, ‘‘কেন্দ্র আর রাজ্যে যাঁরা ক্ষমতায়, তাঁরা যখন ভোট চাইতে আসবেন, তখন কী বলব, সেটা মনে জমিয়ে রেখেছি।’’

শ্রমিক মহলে, তাঁদের পরিবারে এই রাগ-ক্ষোভের পাশাপাশি, রয়েছে প্রশ্নও। দেশে করোনা-সংক্রমণ বাড়ার আগে, বহু কষ্টে জমানো টাকা ফুরোনোর আগে পরিযায়ীদের ঘরে ফেরানো হল না কেন, তার একটি। আর একটি প্রশ্ন— কেন নিজের রাজ্য ছেড়ে বিভুঁইয়ে কাজে যেতে হচ্ছে বাংলার শ্রমিকদের?

লকডাউনের মধ্যে রাজস্থানের জয়পুর থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হওয়ার পরে, উত্তরপ্রদেশের ঔরৈয়ায় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় পুরুলিয়ার সাত পরিযায়ীর। তাঁদের এক জন পুরুলিয়া মফস্সল থানার দুমদুমি গ্রামের চন্দন রাজোয়াড়। চন্দনের দাদা আদিত্যের কথায়, ‘‘ভাই কলেজে ভর্তি হয়েছিল। গ্রামে কাজ পেলে কি আর সাধ করে পড়া ছেড়ে অত দূরে কাজ করতে যায়?’’ কোটশিলার উপরবাটরি গ্রামের মলিন্দ্র মাহাতো ওই দুর্ঘটনাতেই হারিয়েছেন তাঁর ছেলে ধীরেনকে। মলিন্দ্রের জিজ্ঞাসা, ‘‘যাঁরা দেহ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারলেন, তাঁরা কি বেঁচে থাকতে ছেলেগুলোকে ফেরাতে পারতেন না!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement