এ ভাবেই ট্রেনে করে ফিরছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। ছবি: পিটিআই
বাড়ি ফিরতে মরিয়া লকডাউনে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকরা। কিন্তু শিল্পমহলের একটা অংশের তাতে আপত্তি। বিশেষ করে নির্মাণ শিল্প-সহ অসংগঠিত ক্ষেত্রে। তাঁদের প্রশ্ন, এখন বাড়ি ফিরে গেলে লকডাউন ওঠার পর শিল্প-কলকারখানা খুললে তখন শ্রমিক কোথায় মিলবে? এই যুক্তিতেই কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে ওই লবি— এমন অভিযোগও উঠেছে শ্রমিক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে। এ বার সেটাই কার্যত সামনে চলে এল কর্নাটকে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আগামী ৫ দিনে যে ১০টি ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল রাজ্য থেকে, সব কটিই বাতিল ঘোষণা করল ইয়েদুরাপ্পা সরকার। তার জেরে ফের মহাসঙ্কটে পড়লেন সে রাজ্যে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকরা। শুধু কর্নাটকেই নয়, আরও অনেক রাজ্য সরকারের উপরেও একই রকম চাপ রয়েছে। ‘ক্রীতদাস’-এর মতো আচরণ— তোপ দেগেছে কংগ্রেস।
গত ৫ মে দক্ষিণ পশ্চিম রেলওয়েকে একটি চিঠি লিখেছিলেন কর্নাটকের করোনা মোকাবিলার নোডাল অফিসার এন মঞ্জুনাথ। ওই চিঠিতে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘পর পর পাঁচ দিন চালানোর জন্য ১০টি বিশেষ ট্রেনের বন্দোবস্ত করা হোক।’’ আগামিকাল বৃহস্পতিবার থেকে ওই ট্রেনগুলি ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ সেই চিঠি তুলে নেওয়ার কথা বলেছেন মঞ্জুনাথ। তিনি লিখেছেন, ‘‘যেহেতু বৃহস্পতিবার থেকে ট্রেন চালানোর প্রয়োজন নেই, তাই আগের চিঠি বাতিল করা হচ্ছে।’’ যদিও কী কারণে ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েও তা বাতিল করা হল, তার কোনও জবাব দেয়নি সরকার পক্ষ।
কর্নাটকের বিরোধী দল কংগ্রেস ট্রেন বাতিলের তীব্র নিন্দা করেছে। শ্রমিকদের ‘পণবন্দি’ করে রাখা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা সিদ্দারামাইয়া বলেন, ‘‘শ্রমিকরা ফিরে যাবেন না কি এখানে থাকবেন, সেটা তাঁরাই ঠিক করুন। সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। কাজ না স্বাস্থ্য— শ্রমিকরা কোনটা বেশি গুরুত্ব দেবেন, সেই সিদ্ধান্ত তাঁদের উপরেই ছাড়া উচিত। কোনও গন্ডগোল হলে তার দায় কে নেবে?’’ তাঁর আরও প্রশ্ন, ‘‘আমরা কি এখনও ক্রীতদাস প্রথা চালু রেখেছি?’’ কর্নাটকের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ডি কে শিবকুমার অভিযোগ তুলেছেন, ‘‘আমরা ওঁদের (পরিযায়ী শ্রমিক) বন্দি রাখতে পারি না। ওঁদের বরং রাজি করানোর চেষ্টা করা উচিত ছিল। তার জন্য সরকার ও প্রোমোটারদের ইনসেনটিভ দেওয়া উচিত ছিল।’’
আরও পড়ুন: করোনায় আরও চার জনের মৃত্যু রাজ্যে, নতুন করে আক্রান্ত ১১২, জানালেন স্বরাষ্ট্র সচিব
তবে একটি সূত্রে খবর মিলেছে, গত কাল মঙ্গলবার রাতে নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রোমোটার-ঠিকাদারদের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পার। ওই বৈঠকে পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফেরানোতে আপত্তি জানিয়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ। বিরোধীদের দাবি, ওই বৈঠকে প্রোমোটার-ঠিকাদার গোষ্ঠীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করেই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা।
তবে আজ বুধবার ইয়েদুরাপ্পা সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করেছেন, ‘‘ইতিমধ্যেই প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাসে প্রায় এক লাখ পরিযায়ী শ্রমিককে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। একই সঙ্গে তাঁদের আর্জি জানিয়েছি, যেখানে নির্মাণ কাজ চলছে, সেখানে থেকে যেতে।’’ আগেই নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য ২০০০ টাকা অনুদান ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। এ দিন ইয়েদুরাপ্পা ওই শ্রমিকদের জন্য আরও ৩০০০ টাকা অনুদান দেওয়ার কথা বলেছেন।
গোড়া থেকেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে চলেছে নানা টানাপড়েন। ২৪ মে লকডাউন ঘোষণার পর লাখ লাখ শ্রমিক হেঁটে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছিলেন। দেশের বহু রাস্তায় দেখা গিয়েছিল সেই নজিরবিহীন দৃশ্য। সেই বাড়ি ফেরার পথে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। তখন বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছিলেন, এই সব পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা না ভেবেই আচমকা লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছে সরকার। তার পর থেকেই ওই শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর বিষয়টি প্রাধান্যের তালিকায় উপরের দিকে ছিল। তা নিয়ে রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে কেন্দ্র আলোচনা চালাচ্ছিল। কিন্তু ঐকমত্যে পৌঁছনো যাচ্ছিল না।
আরও পড়ুন: বাড়িতে গৃহ সহায়িকারা কি এখন আসতে পারেন? কী বলছে সরকারি নির্দেশ
অধিকাংশ রাজ্যের দাবি ছিল, এত বিপুল সংখ্যক লোককে বাসে করে নিজেদের রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। আবার বাসে করে তাঁদের রাজ্যের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না বলেও অনেকে বেঁকে বসেছিলেন। তাই ট্রেন চালানোর দাবি উঠেছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কী ভাবে নাম নথিভুক্ত হবে, কাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে, বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কী ভাবে বাড়ি পাঠানো সম্ভব— এই সব নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়।
শেষ পর্যন্ত ৩ মে কেন্দ্রের তরফে ঘোষণা করা হয়, পড়ুয়া, পর্যটক ও পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজের রাজ্যে ফিরতে পারবেন। তার জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের ভাড়া নিয়ে আবার বিভ্রান্তি ছড়ায়। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র ৮৫ শতাংশ ভাড়ার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই জট কাটার পরে এখন আবার শুরু হয়েছে এই চোরাস্রোত। অনেক রাজ্য সরকারের উপরেই এ নিয়ে চাপ রয়েছে বলে একাধিক শ্রমিক সংগঠনগুলি অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে। আবার বাড়ি ফিরতে না পেরে একাধিক রাজ্যে বিক্ষোভও শামিল হয়েছেন শ্রমিকরা। পুলিশের সঙ্গে কার্যত খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে গুজরাতের সুরাতে। বিক্ষোভ হয়েছে রাজকোটেও। একই রকম ঘটনা ঘটেছে তেলঙ্গানার হায়দরাবাদেও। ফলে কর্নাটক-সহ একাধিক রাজ্যেই ক্ষোভ বাড়ছে বাড়ি ফিরতে চাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে।