অনলাইনে বৈঠক সিপিএম পলিটব্যুরোর। —নিজস্ব চিত্র।
ভাঙছে আড়ষ্টতার বাঁধন। সময়ের দাবি মেনে বাস্তববাদী হচ্ছে সিপিএম!
কেন্দ্রে তখন ইউপিএ সরকার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ফোনে ধরতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। মুখ্যমন্ত্রী তখন জেলার পথে। শেষমেষ সভামঞ্চের পিছনে গিয়ে ব্যক্তিগত সহায়কের মোবাইল থেকে মনমোহনের সঙ্গে কথা সেরেছিলেন বুদ্ধবাবু। তবু মোবাইল না থাকার জন্য কোনও অসুবিধার ভাবনা ছিল না তাঁর। ল্যান্ডলাইন নির্ভর বুদ্ধবাবু হেসে বলেছিলেন, এই বেশ ভাল আছি!
তাঁর সেই দলের তেমন নিরুত্তাপ থাকার দিন শেষ! লকডাউনের মধ্যে তাই সিপিএমের পলিটব্যুরোর বৈঠক হল অনলাইনে!কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ ইতিহাসে যাকে ছোটখাটো বিপ্লবই বলা যায়! প্রথা ভাঙতে যাদের বরাবরই শত আপত্তি, তাদের যুগের সঙ্গে তাল রেখে আধুনিক হয়ে ওঠাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই ধরছেন অনেকে।
আরও পড়ুন: ‘গেট ওয়েল সুন’, বার্তা পেয়েই মুছে গেল বেশ কয়েক বছরের বিচ্ছিন্নতা
আগরতলায় মানিক সরকার। তিরুঅনন্তপুরমে পিনারাই বিজয়ন ও কোডিয়ারি বালকৃষ্ণন। হায়দরাবাদে বি ভি রাঘবুলু। কানপুরে সুভাষিণী আলি। কলকাতায় সূর্যকান্ত মিশ্র ও মহম্মদ সেলিম। এবং দিল্লিতে সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ ও বৃন্দা কারাট। নিজেদের শহরে থেকেই মঙ্গলবার এঁরা সবাই পলিটব্যুরো বৈঠকে মিলিত হলেন ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে। লকডাউনের বাজারে গোটা কর্পোরেট জগৎ এবং আরও নানা ক্ষেত্রের ভরসা এখন অনলাইন যোগাযোগ। কিন্তু সিপিএমের অনলাইন পলিটব্যুরোর তাৎপর্যই আলাদা! যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার দায়ে বারে বারে কাঠগড়ায় উঠতে হয়েছে যাঁদের, তাঁরাই দিব্যি ওয়েবক্যামের সামনে বসে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চালিয়ে নিলেন!
আরও পড়ুন: বঙ্গে অমিত শাহের ‘ভার্চুয়াল র্যালি’! সাজ সাজ রব রাজ্য বিজেপিতে
প্রথমে পরিকল্পনাহীন লকডাউন, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, তার পরে আর্থিক প্যাকেজের নামে ‘ধোঁকা’। লকডাউনের সুযোগ নিয়ে শ্রম আইন থেকে বিদ্যুৎ আইন সংশোধন করে ফেলার কেন্দ্রীয় সরকারি প্রচেষ্টা। এ সবই আলোচনা হয়েছে পলিটব্যুরোয়। কেরলে বিজয়ন সরকারের চার বছর পূর্তিতে দলের অভ্যন্তরীণ রিপোর্টও এসেছে আলোচনায়। তবে আলোচ্য নয়, এ বার রাজনৈতিক শিবিরের চর্চার কেন্দ্রে আলোচনার পদ্ধতিটাই।
রাজীব গাঁধীর জমানায় কম্পিউটার-বিরোধী আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। যদিও সিপিএম নেতারা বলেন, তাঁদের আন্দোলন কম্পিউটার প্রচলনের বিরুদ্ধে আসলে ছিল না। ছিল কর্মী সঙ্কোচনের প্রতিবাদ। সে বিতর্ক পিছনে ফেলে এই লকডাউনেই আলিমুদ্দিনে সাপ্তাহিক রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকের রেওয়াজ বদলে আলোচনা হয়ে যাচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকও হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপে। বাংলায় দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবুর সম্পাদনায় তাত্ত্বিক মুখপাত্র ‘মার্ক্সবাদী পথ’-এর বিশেষ ‘প্যান্ডেমিক’ সংখ্যা সোমবারই প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন সংস্করণে। সে-ও নতুন ইতিহাস।
ইয়েচুরি, সূর্যবাবুরা বহু দিনই অবশ্য প্রযুক্তি সড়গড়। তবে দলের ব্যবহারিক আঙ্গিকে প্রযুক্তিকে এনে ফেলতে পরিশ্রম লেগেছে বটেই! ইয়েচুরির কথায়, ‘‘সনিয়া গাঁধীর ডাকে ২২টি বিরোধী দলের বৈঠকও হয়েছে অনলাইনে। এখন ভিন্ন পথ খোলা নেই।’’ মানিকবাবুর মতে, নতুন অনেক কিছু শিখতে শিখতেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দেশের বিরাট অংশের মানুষের কাছে এখনও অনলাইন যোগাযোগের সুযোগ নেই। তাই ‘ডিজিটাল ডিভাইড’-এর বিরুদ্ধেও তাঁদের লড়াই জারি থাকবে।