ভারতে মোট কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়াল। গ্রাফিক-শৌভিক দেবনাথ।
দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা যে ১ কোটিতে পৌঁছবে, সেটা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই সংখ্যা পেরিয়ে গেল শনিবার। সময় লাগল প্রায় ১১ মাস। এই নিয়ে আমেরিকার পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে এক কোটি করোনা আক্রান্তের তালিকায় নাম উঠে গেল ভারতের। তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখে যত তাড়াতাড়ি কোটির অঙ্ক স্পর্শ করবে বলে মনে করা হচ্ছিল, হল তার চেয়ে অনেক দেরিতে। কারণ অক্টোবরের পর থেকেই সংক্রমিতের সংখ্যা নামতে শুরু করেছিল। সেই গ্রাফ এখনও নিম্নমুখী। ফলে অনেকটাই স্বস্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
স্বস্তি আরও একটি কারণে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা এমন সময়ে কোটিতে পৌঁছল, যখন অন্তত দু’তিনটি টিকা প্রায় প্রস্তুত। সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায়। এমনকি ভারতীয় বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার করা এবং দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ভারত বায়োটেকের টিকাও মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের তৃতীয় তথা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ফলে টিকা চলে এলে সংক্রমিতের সংখ্যা আর লাফিয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। বরং আরও কমতে থাকবে প্রতিদিন। ফলে সংখ্যাটা দেড় কোটিতে পৌঁছনোর আগেই পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলেই মনে করছেন চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞরা।
দৈনিক সংক্রমণের এই নিম্নগতির কারণ একাধিক, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, রোগ এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যাওয়া। কোনও একটি জনগোষ্ঠীতে ব্যাপক হারে কোনও রোগ-জীবাণুর প্রাদুর্ভাব হলে তার প্রতিরোধ বা সংক্রমণ রুখে দেওয়ার মতো জৈবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিক ভাবেই তৈরি হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একেই বলা ‘হার্ড ইমিউনিটি’। দেশে সংক্রমিতের সংখ্যা যত বেড়েছে, ততই এই প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে।
পাশাপাশি, সংক্রমণের প্রায় ১১ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় অনেকটাই কেটে গিয়েছে। সংক্রমণের গোড়া থেকেই এমন পরিস্থিতি ছিল যে, সামান্য সর্দি-কাশি হলেও টেস্ট করাতে ছুটছিলেন মানুষ। কিন্তু এখন বহু মানুষ সেটা সাধারণ সর্দি-জ্বর বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। তা ছাড়া করোনা সংক্রমণ হলেও ১৪ দিন একটু সাবধানে থাকলে সামান্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আবার হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও কমেছে অনেক। আশঙ্কাজনক না হলে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন না অনেকে। পাশাপাশি সচেতনতাও এখন অনেক বেড়েছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, ৬৮ দিনের সম্পূর্ণ লকডাউনও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই কাজে এসেছে। দেশে লকডাউন শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ। ওই দিন দেশে ২৪ ঘণ্টায় নতুন সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল ৮৭। মোট কোভিড আক্রান্ত ছিলেন মাত্র ৬০৬ জন। অর্থাৎ তখন সবে শুরু হয়েছিল সংক্রমণ। ফলে লকডাউনের মধ্যেও লাফিয়ে বাড়ছিল সংক্রমণ। তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু পরের দিকে সংক্রমণ দ্রুত নেমে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন তড়িঘড়ি লকডাউন ঘোষণা করা।
কিন্তু ১ থেকে কোটি— এই দীর্ঘ ১১ মাসের যাত্রাপথটা একবার দেখে নেওয়া যাক। দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী ধরা পড়েছিল ৩০ জানুয়ারি। চিনের উহান থেকে কেরলে ফেরার পর ধরা পড়েছিল সংক্রমণ। গোড়ার দিকে ভাইরাস ছড়ানোর গ্রাফ খুব ধীর হবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। ফলে দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষে পৌঁছেছিল ১৯ মে। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে তিন মাস পর। তত দিনে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে লাফিয়ে। ফলে ১ লক্ষ থেকে ২ লক্ষে পৌঁছতে সময় লেগেছে মাত্র মাত্র ১৭ দিন। এর পর ৫ লক্ষে পৌঁছেছে ২৭ জুন, ১০ লক্ষে ১৭ জুলাই। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লক্ষ হয়েছে ৭ অগস্ট। ৫০ লক্ষে পৌঁছেছে ১৬ সেপ্টেম্বর। ওই দিন ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৯০ হাজার ১২৩। আবার তার পরের দিনই ২৪ ঘণ্টায় নতুন সংক্রমণের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি— ৯৭ হাজার ৮৯৪। এটাই দেশে এক দিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ। তার পর থেকেই কমতে শুরু করেছে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা। টানা ৫ দিন আক্রান্তের সংখ্যা কমেছিল। তার পর আবার কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে আবার নামতে শুরু করে।
এই ভাবে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক সময় যে ১ কোটিতে পৌঁছবে, তা আন্দাজ করাই যাচ্ছিল। সেই সংখ্যায় পৌঁছল শনিবার। শনিবার সকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৪ হাজার ৫৯৯। গত ২৪ ঘণ্টায় মোট নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ হাজার ১৫২ জন।
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। চলন্ত গড় কী এবং কেন তা লেখার শেষে আলাদা করে বলা হয়েছে।)
এই নিয়ে আমেরিকার পর বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ভারতে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়াল। জন হপকিন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই মুহূর্তে আমেরিকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৭৪ লক্ষ ৫৯ হাজার। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, আমেরিকার জনসংখ্যা ভারতের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। ৩৩ কোটিরও কিছু কম। অথচ সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ভারতের প্রায় ১.৭ গুণেরও বেশি। ফলে ভারত যে অনেকটাই স্বস্তিদায়ক জায়গায় রয়েছে এ কথা বলাই যায়।
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। )
মোট আক্রান্ত কোটি ছাড়ালও দেশে কোভিড রোগীদের সুস্থতার হার শুরু থেকেই স্বস্তিদায়ক। শুরু থেকেই তা আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের থেকে বেশি। এখনও অবদি দেশে মোট ৯৫ লক্ষ ৫০ হাজার ৭১২ জন সুস্থ হয়েছেন। অর্থাৎ দেশের মোট আক্রান্তের প্রায় সাড়ে ৯৫ শতাংশই সুস্থ হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ২৯ হাজার ৮৮৫ জন। পাশাপাশি দৈনিক মৃত্যুও কমেছে অনেকটাই। গত এক সপ্তাহ ধরে তা ৪০০-র নীচে রয়েছে। করোনার জেরে এখনও অবধি মৃত্যু হয়েছে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ১৩৬ জনের।
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। চলন্ত গড় কী এবং কেন তা লেখার শেষে আলাদা করে বলা হয়েছে।)
যদিও বিজ্ঞানী চিকিৎসকদের সাবধানবাণী, দৈনিক নতুন আক্রান্তের সংখ্যায় লাগাম পরানো গেলেও ভাইরাস কিন্তু নির্মূল হয়নি। তাই যে কোনও রকমের অসাবধানতা কিন্তু আবার বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে। এমনকি, টিকা প্রয়োগ শুরু হওয়ার পরেও করোনার বিধিনিষেধ মেনে চলতেই হবে, যত দিন ভাইরাস পুরোপুরি নির্মূল হচ্ছে।
(চলন্ত গড় বা মুভিং অ্যাভারেজ কী: একটি নির্দিষ্ট দিনে পাঁচ দিনের চলন্ত গড় হল— সেই দিনের সংখ্যা, তার আগের দু’দিনের সংখ্যা এবং তার পরের দু’দিনের সংখ্যার গড়। উদাহরণ হিসেবে— দৈনিক নতুন করোনা সংক্রমণের লেখচিত্রে ১৮ মে-র তথ্য দেখা যেতে পারে। সে দিনের মুভিং অ্যাভারেজ ছিল ৪৯৫৬। কিন্তু সে দিন নতুন আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ৫২৬৯। তার আগের দু’দিন ছিল ৩৯৭০ এবং ৪৯৮৭। পরের দুদিনের সংখ্যা ছিল ৪৯৪৩ এবং ৫৬১১। ১৬ থেকে ২০ মে, এই পাঁচ দিনের গড় হল ৪৯৫৬, যা ১৮ মে-র চলন্ত গড়। ঠিক একই ভাবে ১৯ মে-র চলন্ত গড় হল ১৭ থেকে ২১ মে-র আক্রান্তের সংখ্যার গড়। পরিসংখ্যানবিদ্যায় দীর্ঘমেয়াদি গতিপথ সহজ ভাবে বোঝার জন্য এবং স্বল্পমেয়াদি বড় বিচ্যুতি এড়াতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়)